দশম শ্রেণীর ইতিহাস: চতুর্থ অধ্যায়
*সঙ্ঘবদ্ধতার গোড়ার কথা:বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ*
**(1 নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর)**
1. কোন বিদ্রোহকে ‘মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত’ বলা হয় ? - সাঁওতাল বিদ্রোহকে
2. ব্যারাকপুরে সিপাহি বিদ্রোহ কবে শুরু হয় ?- 1857 খ্রিস্টাব্দের 29 মার্চ
3. 1857 খ্রিস্টাব্দের সংগঠিত বিদ্রোহের নাম কী ? - মহাবিদ্রোহ।
4. ব্যারাকপুরে সিপাহি বিদ্রোহের সূচনা করেন কে ?- মঙ্গল পান্ডে
5. সিপাহি বিদ্রোহের একটি কেন্দ্রের নাম করো।- ব্যারাকপুর/দিল্লি।
6. সিপাহি বিদ্রোহের প্রথম শহিদ কে ? - মঙ্গল পান্ডে।
7. মঙ্গলপান্ডের ফাঁসি হয় কবে ?- 1857 খ্রিস্টাব্দে 8 এপ্রিল
8. মহাবিদ্রোহে যোগদানকারী একজন নেত্রীর নাম করো। - ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই।
9. 1857 খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহের একজন নেতার নাম করো।- নানাসাহেব।
10. সিপাহি বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ কী ?- এনফিল্ড রাইফেলের ঘটনা।
11. সিপাহি বিদ্রোহকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলেছেন কে ? - দামোদর বিনায়ক সাভারকর
12. সিপাহি বিদ্রোহকে ‘প্রথম জাতীয় বিদ্রোহ’ বলে ঘোষণা করেন কে ?- ব্রিটিশ সাংসদ ডিজরেলী
13. সিপাহি বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন বলেছেন কে ? - রমেশচন্দ্র মজুমদার
14. ‘ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত ও মৃতপ্রায় সমস্ত শ্রেণির মৃত্যুকালীন আর্তনাদ’ বলা হয় কোন্ বিদ্রোহকে ?- সিপাহি বিদ্রোহকে
15. মহাবিদ্রোহের পর ভারতের শাসনভার কে গ্রহণ করেছিলেন ?- মহারানি ভিক্টোরিয়া।
16. সিপাহি বিদ্রোহের সময় মোগল সম্রাট কে ছিলেন ? - দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ।
17. সিপাহি বিদ্রোহের সময় ভারতের বড়োলাট কে ছিলেন ?- লর্ড ক্যানিং।
18. ভারতের ‘ম্যাকিয়াভেলি’ বলা হত কাকে ?- নানাসাহেবকে ভারতের
19. নানাসাহেবের প্রকৃত নাম কী ? - ধন্দুপথ গোবিন্দ।
20. বলাকোটের যুদ্ধ কবে হয় ?- 1831 খ্রিস্টাব্দে
21. ‘এইটিন ফিফটি সেভেন’ গ্রন্থের লেখক কে ?- ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন।
22. ‘আওয়াধ ইন 1857-58' গ্রন্থের লেখক কে? - ড. রুদ্রাংশু মুখার্জি।
23. ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের লেখক কে?- জওহরলাল নেহরু।
24. কত খ্রিস্টাব্দে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান হয় ?- 1858 খ্রিস্টাব্দে
25. কোন বছর ভারতে ‘বোর্ড অব কন্ট্রোল’-এর অবসান হয়?- 1858 খ্রিস্টাব্দে
26. কোন আইনের দ্বারা ভারতে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটে ?- 1858 খ্রিস্টাব্দের কোম্পানি আইন দ্বারা
27. ‘মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্র’ কবে ঘোষিত হয় ?- 1858 খ্রিস্টাব্দের 1 নভেম্বর
28. ‘মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্র’কে পাঠ করে শোনান ?- লর্ড ক্যানিং
29. মহারানি ভিক্টোরিয়াকে কবে ভারত সম্রাজ্ঞী’ বলে ঘোষণা করা হয়?-1877 খ্রীষ্টাব্দে।
30. ভারতের প্রথম ভাইসরয় কে ছিলেন ?- লর্ড ক্যানিং।
31. ভারতে প্রথম কবে ‘কাউন্সিল অ্যাক্ট’ ঘোষিত হয় ?-1861 খ্রিস্টাব্দে
32. প্রথম ভারত-সচিব কে ছিলেন ? - লর্ড স্ট্যানলে
33. উনিশ শতককে কে ভারতের ‘সভাসমিতির যুগ’ বলেছেন? - ড. অনিল শীল
34. ভারতের সংগঠিত রাজনৈতিক আন্দোলনের জনক’বলা হয় কাকে ?- রাজা রামমোহন রায়কে
35. বরিশালের মুকুটহীন রাজা বলা হত কাকে ?- অশ্বিনীকুমার দত্তকে
36. ভারতের প্রতিষ্ঠিত প্রথম রাজনৈতিক সংগঠনের নাম কী ?- বঙ্গভাষা প্রবেশিকা সভা।
37. কত খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভাষা প্রবেশিকা সভা’ স্থাপিত হয় ?- 1836 খ্রিস্টাব্দে
38. ‘জমিদার সভা কবে প্রতিষ্ঠিত হয় ?- 1838 খ্রিস্টাব্দে
39. ‘জমিদার সভার’ একজন উদ্যোক্তার নাম কী ? - দ্বারকানাথ ঠাকুর/রাধাকান্ত দেব।
40. কত খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান লিগ’ প্রতিষ্ঠিত হয় ? - 1875 খ্রিস্টাব্দে
41. কত খ্রিস্টাব্দে ভারতসভা স্থাপিত হয় ?- 1876 খ্রিস্টাব্দে
42. ‘রাষ্ট্রগুরু’ উপাধিতে কে ভূষিত হন ? - সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
43. বাংলার মুকুটহীন রাজা’ কাকে বলা হত ? - সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
44. কত খ্রিস্টাব্দে ‘হিন্দুমেলা’ প্রতিষ্ঠিত হয় ?- 1867 খ্রিস্টাব্দে
45. ‘ন্যাশনাল নবোপাল’ বলা হত কাকে ? - নবগোপাল মিত্রকে।
46. ‘হিন্দুমেলা’র প্রতিষ্ঠাতা কে ? - নবগোপাল মিত্র ও রাজনারায়ণ বসু।
47. হিন্দুমেলার পূর্ব নাম কী ছিল?- চৈত্র মেলা।
48. ‘জাতীয় মেলা’ কবে প্রতিষ্ঠিত হয় ?-1867 খ্রিস্টাব্দে
49. ‘লোকহিতবাদী’ উপাধিতে কে ভূষিত হন?-গোপালহরি দেশমুখ
50. ‘পুনা সার্বজনিক সভা’র প্রতিষ্ঠাতা কে ?- গোপালহরি দেশমুখ
51. ‘ভারতসভার’ উদ্যোগে প্রথম সর্বভারতীয় সম্মেলন কবে আহূত হয় ?-1883 খ্রিস্টাব্দে
52. ভারতসভার উদ্যোগে আহুত ‘প্রথম সর্বভারতীয় সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন কে ?- রামতনু লাহিড়ি
53. ইংরেজরা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কী নামে ডাকত ?- সারেন্ডার নট
54. কত খ্রিস্টাব্দে ভারতসভা জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হয় ?- 1885 খ্রিস্টাব্দে
55. ‘জাতীয় কংগ্রেস কবে প্রতিষ্ঠিত হয় ?- 1885 খ্রিস্টাব্দে
56. ‘জাতীয় কংগ্রেসের জনক’ কাকে বলা হয় ?- অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউমকে
57. কোন পত্রিকায় ‘জাতীয় কংগ্রেস’ কথা দুটি প্রথম প্রকাশিত হয় ?- ‘বেঙ্গলি’
58. যখন ‘জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় তখন ভারতের ভাইসরয় কে ছিলেন ?- লর্ড ডাফরিন।
59. কার উদ্যোগে ‘বি.বি.আই-সমিতি’ গড়ে ওঠে ?-দ্বারকানাথ ঠাকুরের
60. সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন কবে হয়েছিল ?-1883 খ্রিস্টাব্দে
61. A Nation in Making গ্রন্থের লেখক কে ?- সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
62. কত খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল-ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া সোসাইটি’ স্থাপিত হয় ?- 1843 খ্রিস্টাব্দে
63. ‘বেঙ্গল-ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া সমিতির’পরবর্তী নাম কী হয় ?- ‘ভারতবর্ষীয় সভা
64. ‘ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’কবে স্থাপিত হয় ?- 1875 খ্রিস্টাব্দে
65. ‘ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সভাপতি কে ছিলেন ?- রাধাকান্ত দেব।
66. ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সম্পাদক কে ছিলেন ?- দ্বারকানাথ ঠাকুর।
67. ‘আনন্দমঠ উপন্যাসের স্রষ্টা কে?-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
68. ‘আনন্দমঠ উপন্যাসে বাংলার কোন্ বিদ্রোহের চিত্র বর্ণিত হয়েছে ?- সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের চিত্র
69. ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বাইবেল বলা হয় কোন গ্রন্থ বা উপন্যাসকে ?- ‘আনন্দমঠ উপন্যাসকে
70. ভারতীয় জাতীয়তাবাদের গুরু’ কাকে বলা হয় ?- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে
71. "The Real father of Indian Nationalism কাকে বলা হয় ?- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে
72. ‘বন্দেমাতরম’কবে ভারতের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয় ?- 1905 খ্রিস্টাব্দে
73. “বন্দেমাতরম’ সংগীতটি কোন উপন্যাসের অন্তর্গত?-আনন্দমঠ উপন্যাসের
74. স্বদেশ প্রেমের গীতা নামে পরিচিত কোন গ্রন্থটি ?- আনন্দমঠ উপন্যাসটি
75. বর্তমান ভারত’ কে রচনা করেন ?- স্বামী বিবেকানন্দ।
76. ‘গোরা’উপন্যাসটি কে রচনা করেন ?- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
77. ভারতমাতা’শব্দটি কোথা থেকে এসেছে?-ভারতম্বা
78. ভারতমাতা’ চিত্রটি কোন্ ঘটনার প্রেক্ষিতে চিত্রিত হয় ?- বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ঘটনার প্রেক্ষিতে
79. ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি কত খ্রিস্টাব্দে আঁকা হয় ?-1905 খ্রিস্টাব্দে
80. কাকে ‘father of modern Indian art’ বলা হয় ?- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে
81. ‘ভারতমাতা’ চিত্রটির পূর্বনাম কী ছিল?-বঙ্গমাতা।
82. নব্যবঙ্গ চিত্রকলার জনক নামে কে পরিচিত ?- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
83. কোন পত্রিকায় প্রথম আধুনিক ভারতীয় ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হয়েছিল ?- অমৃতবাজার পত্রিকায়
84. ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কে ছিলেন ?- গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
85. ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট প্রতিষ্ঠিত হয় কত খ্রিস্টাব্দে ?- 1907 খ্রিস্টাব্দে
*** (২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর)***
1. সভা সমিতির যুগ বলতে কী বোঝো অথবা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধকে সভা সমিতির যুগ বলা হয় কেন?
>>উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জাতীয় জাগরণের ঊষালগ্নে ভারতবাসি উপলদ্ধি করে যে, অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দেশীয় স্বার্থরক্ষা ও সমাজ কল্যানের জন্য জনমত গঠনের একমাত্র উপায় হল সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন। এই প্রেক্ষাপটে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। যেমন কলকাতায় বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা, মাদ্রাজের মাদ্রাজ মহাজন সভা এবং বোম্বায়ে জাতীয় কংগ্রেস প্রভৃতি। এই জন্য ঊনিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধকে ডঃ অনীল শীল সভা সমিতির যুগ বলে অবিহিত করেছেন।
2. ভারতমাতা চিত্রের গুরুত্ব কি ?
>>ভারতমাতার চিত্রটি শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক অসামান্য সৃষ্টি। বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে এই ব্যাঞ্জনাময় চিত্রট অঙ্কিত হয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশমাতার প্রতিমূর্তি হিসেবে একটি গেরুয়া বস্ত্র পরিহিতা চার হাত বিশিষ্ট একটি নারীর চিত্র এঁকেছেন যার চারটি হাতে পুস্তক , ধানের শিষ, শ্বেত বস্ত্র ও জপের মালা আছে। এই কাল্পনিক ভারতমাতা নীল আকাশের নীচে পৃথিবীর উপর দাঁড়িয়ে আছে। তিনি জাতীয়তার প্রতীক। বিদেশি শাসনের বন্ধন থেকে তিনি জাতিকে জেগে ওঠার আহ্বান জানাচ্ছেন। এদিক দিয়ে জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করার ক্ষেত্রে চিত্রটির গুরুত্ব অপরিসীম। ভগিনী নিবেদিতা ভারতমাতা চিত্রটির অকুন্ঠ প্রসংশা করেছেন।
3. হিন্দু মেলার অপর নাম কি এর উদ্দেশ্য কি ছিল?
>>হিন্দু মেলার অপর নাম চৈত্র মেলা।১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে নবগোপাল মিত্রের উদ্যোগে কলকাতায় ‘জাতীয় মেলা’ বা ‘চৈত্র মেলা’ বা ‘হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠিত হয়।
হিন্দুমেলার উদ্দেশ্য ; (i) বাংলা তথা ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশেষ করে শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যবোধ জাগ্রত করা, (ii) হিন্দুধর্মের অতীত গৌরবগাথা ছড়িয়ে দেওয়া, (iii) সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটানো বিশেষ করে শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করা, (iv) পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রসার প্রতিরোধ করা, (v) জাতীয় প্রতীকগুলিকে মর্যাদা দেওয়া ইত্যাদি ছিল এর উদ্দেশ্য।
4. ইউরোপীয়রা কেন ইলবার্ট বিলের বিরোধিতা করেন ?
>>লর্ড রিপন তার আইন সচিব কোর্টনি পি ইলবার্টের মাধ্যমে ভারতীয় বিচার ব্যবস্থায় বৈষম্য দূর করার জন্য একটি বিল প্রস্তুত করেন। এটি ‘ইলবার্ট বিল’ নামে পরিচিত।
ইলবাট বিলের সংশোধন : এই বিলে ভারতীয় বিচারকদের শ্বেতাঙ্গদের বিচারের অধিকার দান করা হলে শাসক জাতি শ্বেতাঙ্গরা তা মানতে অস্বীকার করে। কলকাতা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার ব্রানসন-এর নেতৃত্বে এর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে ‘ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন’। ভারত ও ইংল্যান্ডে ইংরেজরা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ শুরু করে। বাধ্য হয়ে লর্ড রিপন জুরি ব্যবস্থা প্রবর্তন করে বিলের সঙ্গে মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য মেনে নেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভা এই বিলের স্বপক্ষে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।
5. জাতীয়তাবাদ বলতে কি বোঝো ?
>>মানবজাতির ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে জাতীয়তাবাদ একটি মহান আদর্শরূপে পরিচিত। জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয় নিজের দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা থেকে। জাতীয়তাবাদ একটি ভাবগত ধারণা। কোনো একটি জনসমাজের মধ্যে বংশ, ভাষা, ধর্ম, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি কারণে ঐক্যবোধ সৃষ্টি হওয়ার ফলে যখন স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য রাজনৈতিক আদর্শ গড়ে ওঠে, তখন সেই আদর্শকে ‘জাতীয়তাবাদ’ বলা হয়।
6. বাঙালি সমাজ কেন মহাবিদ্রোহ কে সমর্থন করেননি?
>>সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সমগ্র শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের বিরোধিতা করেন। এমনকি বিদ্রোহ দমনে সরকারকে সাহায্যের প্রস্তাবও দেন।
সমর্থন না করার কারণ কারণ :
(i) তাঁরা ব্রিটিশ শাসনকে ভারতের পক্ষে কল্যাণকর মনে করতেন (ii) ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর কেউ ভারতে জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কিনা তাতে তারা ছিলেন সন্দিহান, (iii) ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে নিজেদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত - হবেন এই ভয়ে তারা ছিলেন ভীত।
7. জমিদার সভার প্রথম সভাপতি কে ছিলেন? এর উদ্দেশ্য কি ছিল?
>>জমিদার সভার প্রথম সভাপতি হলেন রাধাকান্ত দেব।1838 খ্রিস্টাব্দের 12 নভেম্বর কলকাতার বিশিষ্ট জমিদাররা গড়ে তোলেন ‘জমিদার সভা’ বা ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি।
জমিদার সভার উদ্দেশ্য : এর লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিল
(i) বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা প্রদেশের জমিদারদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও স্বার্থ রক্ষা করা, (ii) ভারতের সর্বত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রসার ঘটানো,(iii) ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রকে জমিদারদের অনুকূলে আনা, (iv) নিষ্কর জমি বাজেয়াপ্ত হতে না দেওয়া, (v) রাজস্ব, বিচার ও পুলিশ বিভাগের সংস্কার সাধনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো ইত্যাদি।
8. গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর কিভাবে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের সমালোচনা করেছেন?
>>বাংলা চিত্রশিল্পও কার্টুন শিল্পের ক্ষেত্রে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (1867-1938 খ্রিঃ) এক উজ্বল ব্যক্তিত্ব। তিনি বিভিন্ন ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক সমাজের তীব্র সমালোচনা করেছেন। এ ছাড়া এগুলিতে বাঙালি চরিত্রের নানা দিক যেমন বাঙালির ইংরেজ প্রীতি, বাঙালির চরিত্রের নানা দিক, ঔপনিবেশিক শাসনের বিভিন্ন দিক ইত্যাদির কথা তুলে ধরেছেন। তিন খণ্ডে প্রকাশিত অদ্ভুত লোক, ‘বিরূপ বস্ত্র’, ‘নয়া হুল্লোড়’ গ্রন্থে তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলি অন্তর্ভুক্ত। এগুলি ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিউ’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি গড়ে তোলেন ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ‘ওরিয়েন্টাল আর্ট’ (1907 খ্রিঃ) নামক এক শিল্প প্রতিষ্ঠান।
9. মহারানীর ঘোষণাপত্র কি?
>>1858 খ্রিস্টাব্দের 1লা নভেম্বর ইংল্যান্ডের মহারানি ভিক্টোরিয়া ভারতের শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে একটি আইন পাস করেন যা ‘মহারানির ঘোষণাপত্র’ নামে পরিচিত। এতে বলা হয়- (i) ব্রিটিশ সরকার অতঃপর ভারতীয়দের ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যাপারে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না, (ii) জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি যোগ্যতাসম্পন্ন ভারতীয়ই সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত হতে পারবে, (iii) এতে ‘স্বত্ববিলোপ নীতি’ পরিত্যক্ত হয় ও দেশিয় রাজাদের দত্তক পুত্র গ্রহণের অধিকার দান করা হয়, (iv) সরকার ভারতে আর সাম্রাজ্য বিস্তার করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, (v) দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে কোম্পানির স্বাক্ষরিত চুক্তি মেনে চলার আশ্বাস দেওয়া হয় ইত্যাদি।
বলাবাহুল্য প্রতিশ্রুতিগুলি ঘোষণাপত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেগুলি পালন করা হয়নি।
10. বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা সম্পর্কে আলোচনা করো।
>>1836 খ্রিস্টাব্দে টাকির জমিদার কালীনাথ রায়চৌধুরি, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমুখের উদ্যোগে কলকাতায় ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’ গড়ে ওঠে।
‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’র প্রধান কার্যাবলিগুলি হল- (i) এখানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা চলতো, (ii) ধর্ম সংক্রান্ত সমস্ত আলোচনা সেখানে নিষিদ্ধ হলেও ব্রিটিশদের গৃহীত। পদক্ষেপগুলি ভারতবাসীর পক্ষে কতটা মঙ্গল-অমঙ্গলের তা এখানে। আলোচনা হত, (iii) 1828 খ্রিস্টাব্দের আইনে নিষ্কর জমির ওপর সরকার কর আরোপ করলে এই সভার মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয় ইত্যাদি।
11. ভারত সভা সম্পর্কে আলোচনা করো।
>>সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি প্রমুখের উদ্যোগে 1876 খ্রিস্টাব্দের 26 জুলাই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’।
উদ্দেশ্য :
ভারতসভার দুটি উদ্দেশ্য ছিল- (i) দেশে শক্তিশালী জনমত গঠন করা, (ii) ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন জাতি ও ধর্মাবলম্বী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা, (iii) হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্যবোধ জাগ্রত করা ও সম্প্রীতি গড়ে তোলা (iv) জনগণকে ব্রিটিশ-বিরোধী ঐক্য আন্দোলনে শামিল করা ইত্যাদি।
12. ইলবার্ট বিল আন্দোলন বলতে কী বোঝো।
>> লর্ড রিপনের (1880-84 খ্রি.) আগে এদেশে কোনো ভারতীয় বিচারক কোনো ইংরেজের বিচার করার অধিকারী ছিল না এই বর্ণবৈষম্য দূর করার উদ্দেশ্যে রিপনের পরামর্শে তার আইন সচিব ইলবার্ট একটি বিল রচনা করেন। এতে ভারতীয় বিচারকরা শ্বেতাঙ্গ ইংরেজদের বিচার করারও অধিকার পায়। এটি ‘ইলবার্ট বিল’ নামে পরিচিত।
13. ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট কি?
>>ভাইসরয় লর্ড লিটনের শাসনকাল সর্বাধিক বিতর্কিত তাঁর 1878 খ্রীস্টাব্দে 14 মার্চ দেশীয় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের জন্য প্রণীত ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট এর জন্য। ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্টের উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় সংবাদপত্রের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রচারণা বন্ধ করা। ভাইসরয় লর্ড লিটন দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রকে কুচক্রী বাজে লেখকদের প্রকাশ্য রাজদ্রোহী প্রচারণা বলে অভিযুক্ত করেন। তিনি মন্তব্য করেন যে, অধিকাংশ দেশীয় সংবাদপত্রের সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্রিটিশ রাজের পতন ঘটানো।
14. অস্ত্র আইন কি?
>> ইংরেজ শাসন-শোষণ ও পীড়নে ভারতবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে বড়োলাট লর্ড লিটন তাদের নিরস্ত্র করার জন্য 1878 খ্রিস্টাব্দে এক আইন পাশ করেন। যা অস্ত্র আইন নামে পরিচিত। এতে বলা হয়, লাইসেন্স ছাড়া কোনো ভারতীয় আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে বা রাখতে পারবে না।
প্রশ্নমান -(4)::
1. মহারানির ঘোষণাপত্র কী? মহারানির ঘোষণাপত্রের গুরুত্ব কী ছিল?
>> উত্তর:
মহাবিদ্রোহের পর ইংল্যাণ্ডের রাজনৈতিক মহল মনে করে যে, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির মতো একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের হাতে ভারতের মতো একটি বিশাল দেশের শাসনভার থাকা উচিত নয়। এই কারণে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর এলাহাবাদে এক দরবারের আয়োজন করে মহারানী ভিক্টোরিয়া ভারতীয়দের কাছে কোম্পানির ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা এক ঘোষনা পত্রের মাধ্যমে পেশ করেন এই ঘটনা ইতিহাসে মহারানীর ঘোষণাপত্র বা Queen’s Proclamation নামে পরিচিত
এই ঘোষণাপত্রে বলা হয় যে,
১) ভারতবাসীর ধর্মীয় ও সামাজিক কোন ব্যাপারেই সরকার কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না।
২) প্রত্যেক ভারতবাসী ধৰ্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে।
৩) জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যোগ্যতাসম্পন্ন সকল ভারতবাসীই সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত হতে পারবে।
৪) স্বত্ববিলোপ নীতি বিলোপ করা হয়।
৫) দেশীয় রাজন্যবর্গকে দত্তক গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয় ।
৬) সরকার ভারতে আর সাম্রাজ্য বিস্তারে আগ্রহী নয়।
৭) দেশীয় রাজ্যগুলিকে আশ্বস্ত করা হয় যে, কোম্পানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত তাদের সব চুক্তি ও সন্ধিগুলিকে মেনে চলা হবে।
এর দ্বারা মূলত দেশীয় রাজ্ন্যবর্গ তথা ভারতীয় সমাজকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল আবার অন্যদিকে এর মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত তৈরি করা হয়েছিল ।কিন্তু মহারানীর ঘোষনাপত্রের প্রতিশ্রুতিগুলি শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।
সমালোচনাঃ বলা বাহুল্য, মহারানির এইসব প্রতিশ্রুতি ঘোষণাপত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল ।
১) মহারানির ঘোষণাপত্রে ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের প্রতি সমান আচরণ ও সমানাধিকারের কথা বলা হয় এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ইংরেজরা নিজেদের ‘রাজার জাতি বলে মনে করত এবং ভারতীয়দের প্রতি তাদের আচরণ ছিল বিজেতা-সুলভ।
২)জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল প্রজার জন্য সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সমানাধিকার নীতি ঘোষণা করেও উচ্চপদস্থ চাকরিগুলির ক্ষেত্রে ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার রুদ্ধ করে দেওয়া হয়।
৩) ভারতীয়রা যাতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে এই উদ্দেশ্যে মহাবিদ্রোহের পরবর্তীকালে সরকার বিভেদ নীতি অবলম্বন করে। বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতিগোষ্ঠী ও অঞ্চলের মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক করে তোলা হয়। সুতরাং ভারতবাসীর সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে ইংরেজদের হস্তক্ষেপ মহাবিদ্রোহের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হলেও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য তারা জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতার বীজ ববন করতে থাকে।
তাই এই আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, মহারানির ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত প্রতিশ্রুতিগুলি বেশির ভাগই ঘোষনাপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই কারণে মহারানির শাসনকালকে অনেকে যেমন ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অধ্যায়’ (period of broken pledges) বলে চিহ্নিত করেছেন।।
2. আনন্দমঠ উপন্যাসটি কীভাবে জাতীয়তবাদী চেতনা বিস্তারে সহায়তা করেছিল?
উত্তর : ভূমিকা : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘আনন্দমঠ উপন্যাসের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের প্রচার করেছিলেন। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর এই উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্বদেশপ্রীতি।
জাতীয়তাবাদী চেতনায় আনন্দমঠ : (i) স্বদেশ প্রেম : বঙ্কিমচন্দ্র রচিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে দেশবাসীর মনে স্বদেশীকতা ও সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ধারণা। সারিত করেছিল।
(i) বন্দেমাতরম সংগীত : ‘আনন্দমঠ উপন্যাসে জন্মভূমিকে মাতৃরূপে কল্পনা করে ‘বন্দেমাতরম’সংগীতটি (১৮৭৫) ছিল পরাধীন ভারতের জাতীয় সংগীত, বিপ্লবীদের
(ii) সন্তান দল : বাংলায় মুসলিম রাজশক্তির পতন ও ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠা এক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে। এই সংকটকালে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশমাতার মুক্তির জন্য সন্তান দলের আবির্ভাব ঘটে।
(iv) আনন্দমঠের মূল বিষয় :‘আনন্দমঠ উপন্যাসে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একদল আত্মত্যাগী সন্ন্যাসীর কার্যাবলির বিবরণ আছে।
উপসংহার : বাঙালির জাতীয়তা গঠন ও দেশের যুব সম্প্রদায়কে স্বদেশভক্তি, ত্যাগ ও সেবাধর্মে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে রচিত ‘আনন্দমঠ’ এর অবদান বাঙালি জাতীয়জীবন গঠনে ওতােপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে।
3. রবীন্দ্রনাথের ‘গােরা’ উপন্যাস সম্পর্কে যা জানাে লেখাে। গােরা’ চরিত্রটি কীভাবে মানবতার জয়গান করেছিল?
উত্তর : ভূমিকা : বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন এর অন্যতম নেতা ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সে আন্দোলনের লক্ষ ছিল বাঙালি ও ভারতীয় জীবন ধারার সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন করা। শুধুমাত্র বিদেশি শাসকশক্তির বিরুদ্ধে নিস্ফলন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
রচনা ও প্রকাশ কাল : ‘গােরা’ উপন্যাসটি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
‘গােরা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে।
গােরা উপন্যাসের সারমর্ম : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহি বিদ্রোহের সময় এক আইরিশ যুদ্ধে মারা যান। তার আসন্ন প্রসবা স্ত্রী ব্ৰণ কৃয়দয়ালের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি এক পুত্র সন্তান প্রসব করেই মারা যান। এই ছেলেটির নাম হয় ‘গােরা’।
জাতীয়তাবােধ : বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের মানসলােকের প্রতীকি চরিত্র হল। গােরা। জাতীয়তাবােধের বিকাশে বহু উপন্যাসের মধ্যে গােরা উপন্যাসটি বিশিষ্টতার দাবি রাখে। বৈশিষ্ট্যগুলি হল।
বিরােধ সমন্বয় : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই উপন্যাসে সমকালীন যুগজীবনের প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন। এক দ্বন্দ্ব ও তা থেকে উত্তীর্ণ এক সামগ্রিক পরিমণ্ডল এখানে। চিত্রিত হয়েছে। জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্য, অভাব ও দারিদ্র্যের সমাধানের ইঙ্গিতও রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন।
মধ্যবিত্ত মানসিকতা : এই উপন্যাসে শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের মানসিকতা ফুটে উঠেছে। বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠা, অনুসন্ধানী মনােভাব, কৌতূহল, মানবতা ফুটে উঠেছে।
সংকীর্ণতা : আইরিশ যুবক গােরা হিন্দু পরিবারে লালিত-পালিত হয়ে নিজের বিদেশি সত্তা ভুলে গিয়ে বাঙালি হয়ে যায়। সমাজের অন্দরে বাসা বাঁধা এই সংকীর্ণতা গােরা উপন্যাসে ফুটে উঠেছে।
উপসংহার : অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গােরা উপন্যাসের মধ্য দিয়ে একদিকে ছড়িয়ে পড়েছে অসম্প্রদায়িকতার বাণী এবং অন্যদিকে জাতীয়তাবাদের মূল প্রকৃতি।
4. ভারতসভা প্রতিষ্ঠাতার উদ্দেশ্যগুলি লেখাে অথবা, ভারতসভার লক্ষ্য কী ছিল?
উত্তর : ভূমিকা : ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক সভা থেকে ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশন জন্মলাভ করে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠিত ভারতসভা, যা প্রাক্কংগ্রেস যুগে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনকে পরিচালিত করেছিল।
উদ্দেশ্য : কলকাতার অ্যালবার্ট হলে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশনের উদ্দেশ্যগুলি ছিল—
প্রথমত, সমগ্র ভারতে শক্তিশালী জনমত জাগ্রত করা।
দ্বিতীয়ত, হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃভাব গড়ে তােলা।
তৃতীয়ত, ভারতের বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের লােককে রাজনৈতিক স্বার্থে সংঘবদ্ধ করা।
কার্যাবলি : (i) কৃষকদের জন্য ভারতসভা জমিদারি অত্যাচার, ১৮৫৯-এর রেন্ট। অ্যাক্ট ইত্যাদির বিরােধিতা করে। (i) সিভিল সার্ভিসে বসার বয়স ভারতীয়দের জন্য কমিয়ে দেওয়া হলে ভারতসভা প্রতিবাদ জানায়। (ii) ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে ভারতসভার আন্দোলন ছিল প্রশংসার যােগ্য।
গুরুত্ব : এই সভার গুরুত্বগুলি ছিল— (i) ভারতবর্ষে ব্রিটিশ জনমত গড়ে ওঠে। (i) দেশে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটতে থাকে। (ii) একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়।
উপসংহার :ভারতসভা তৎকালীন ব্রিটিশের অন্যাস নিয়মকানুন, আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। বড়ােলাট লর্ড রিপনের প্রতিক্রিয়াশীল আইনের বিরুদ্ধেও ভারতসভা বিপুল জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল
5. 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের মনোভাব কি ছিল?
অথবা 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় কেন সমর্থন করেননি?
উত্তর::
1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে সেই সময়ের শিক্ষিত বাঙালি সমাজ সমর্থন করেনি; উপরন্তু তারা বিদ্রোহী সিপাহিদের ও বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত নেতানেত্রীদের ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছিল। শিক্ষিত বাঙালি সমাজ এই বিদ্রোহে বিদ্রোহীদের পরাজয় ও ব্রিটিশদের জয় কামনা করেছিল।
শিক্ষিত বাঙালি সমাজের বিরোধিতার কারণ :শিক্ষিত বাঙালি সমাজবিভিন্ন কারণে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল।
i) মধ্যযুগীশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার ভয়ে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ মনে করেছিল বিদ্রোহীরা জয়লাভ করলে ভারতে আবার মধ্যযুগীয় মুঘল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। তারা মধ্যযুগীয় মুঘল শাসনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন।
ii) শিক্ষিত বাঙালি সমাজ ছিল আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কারের সমর্থক। তারা মনে করেছিল বিদ্রোহীরা জয়ী হলে তাদের সামন্ততান্ত্রিক শাসনে আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কারের অবসান ঘটবে। আধুনিকতার অবসানের ভয়েও তারা সমর্থন করেননি?
বিরোধিতাঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি বাঙালি সমাজ সেই সময়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তীব্র বিদ্বেষ প্রকাশ করে।
i) সভা করে বিরোধিতা করা: বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাজা রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা হয়। সভায় বিদ্রোহীদের নিন্দা করা হয়।
ii) মেট্রোপলিটন কলেজের সভা: রাজা রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে বিদ্রোহবিরোধী আরও একটি সভা হয় মেট্রোপলিটন কলেজে (২৬ মে, ১৮৫৭ খ্রি.)। এই সভায় উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ, কমলকৃষ্ণ বাহাদুর,হরচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। তারা সরকারকে সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সভায় প্রস্তাব পাস করেন এবং সরকারের কাছে তা পেশ করেন।
iii) পত্রপত্রিকায় বিরোধিতা: সংবাদ ভাস্কর, সংবাদ প্রভাকর প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় শিক্ষিত বাঙালি সমাজবিদ্রোহীদের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদকের সিপাহি বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লিখেছিলেন যে, ‘হে বিঘ্ন হর..... ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের জয়পতাকা চিরকাল সমভাবে উড্ডীয়মান কর। অত্যাচারি অপকারি বিদ্রোহকারি দুর্জনদিগকে সমুচিত প্রতিফল প্রদান কর। " এছাড়াও বিভিন্ন গ্রন্থ সমূহেও বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় নানাভাবে বিরোধিতা করেছিল।
যাইহোক খুব শীঘ্রই বাঙালি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ভুল ভেঙে যায়, তাদের সামনে ব্রিটিশ সরকারের নগ্ন রূপ উন্মোচিত হয়। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকারের দমন মূলক কার্যকলাপ লক্ষ্য করে শিক্ষিত বাঙ্গালীদের ব্রিটিশ শাসনের প্রতি মোহ ভঙ্গ হয়েছিল এবং তারা জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী হয়েছিলেন।
6. টিকা লিখো :: ইলবার্ট বিল আন্দোলন
উত্তর:
ইলবার্ট বিল : ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ফৌজদারি আইন অনুসারে ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচার করার ক্ষমতা ভারতীয় বিচারকের ছিল না । একমাত্র ইউরোপীয় বিচারকগণই ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচার করতে পারতেন। ব্রিটিশ ভারতের বিচারব্যবস্থায় জাতিভেদমূলক বৈষম্য দূর করার জন্য ভাইসরয় লর্ড রিপনের পরামর্শ অনুসারে তার কাউন্সিলের আইন সদস্য ইলবার্টএকটি আইনের খসড়া তৈরি করেন, যা ইলবার্ট বিল [Ilbert Bill] নামে পরিচিত।
বিতর্কঃ এই খসড়া আইনে ভারতীয় বিচারকদের ইউরোপীয় বিচারকদের সমতুল্য মর্যাদা ও ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয় এবং বলা হয় যে, ভারতীয় বিচারকরাও ইউরোপীয় বিচারকদের বা শ্বেতাঙ্গদের বিচার করতে পারবেন।
আন্দলোনঃ ইলবার্টের খসড়া আইনটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয়রা ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন শুরু করে, কারণ এই খসড়া আইনটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হলে ভারতীয় বিচারকদের কাছে ইউরোপীয়দের বিচার প্রার্থী হতে জাত অভিমানে লাগত এবং সেক্ষেত্রে তাদের মর্যাদা ইউরোপীয় বিচারকদের সমতুল্য হত । ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে ইউরোপীয়দের এই আন্দোলন 'শ্বেতাঙ্গ বিদ্রোহ' (White mutiny) নামে খ্যাত । বিলটি প্রত্যাহারের জন্য ইংরেজ আইনজীবী কেসুয়িক, মিলার ব্রানসন -এর নেতৃত্বে ‘ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন’ নামে এক সংস্থা গঠন করে আন্দোলন চালায়।
প্রতি-আন্দোলন :- ১৮৮৩-৮৪ খ্রিস্টাব্দে ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে ইউরোপীয়দের আন্দোলন ও বিক্ষোভের প্রত্যুত্তরে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভা প্রতি-আন্দোলন গড়ে তোলে । ইলবার্ট বিলের সমর্থনে ভারতসভা দেশের নানা স্থানে জনসভা করে এবং সংবাদপত্রে মতামত জানাতে থাকে । কিন্তু সরকার শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয়দের দাবির কাছে মাথা নত করে । প্রস্তাবিত আইনের খসড়াটি বাতিল করা হল না বটে, কিন্তু তার কয়েকটি উদারনৈতিক ধারা এমন ভাবে সংশোধন করা হয় যাতে ইলবার্ট বিলের আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায় ।সংশোধনীতে বলা হয়, ভারতীয় বিচারক ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচার করতে পারবেন কিন্তু সেক্ষেত্রে তাঁকে ইউরোপীয়দের মনোনীত জুরির সাহায্য নিতে হবে ইত্যাদি ।
ইলবার্ট বিল আন্দোলনের গুরুত্ব :- ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে ইলবার্ট বিল আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম ।
(১) ইলবার্ট বিল আন্দোলনে ইউরোপীয়দের বর্ণবিদ্বেষ ও ভারতীয়দের প্রতি ঘৃণা তাঁদের চোখ খুলে দেয় । তাঁরা উপলবদ্ধি করেন ভারতবাসী মাত্রেই ইংরেজদের চোখে ঘৃণার পাত্র। ফলেতারা নিজেদের সম্মান সম্পর্কে সচেতন হন ।
(২) ইলবার্ট বিল আন্দোলন একথা প্রমান করে যে সংবদ্ধ আন্দলন না করলে কোন কিছুর আদায় করা যায়না সেই ব্যাপারে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ সচেতন হয়।
6. 1857 সালের সালের বিদ্রোহকে কেন সামন্ত শ্রেণীর বিদ্রোহ বলা হয়?
উত্তর:
সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া : বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে কিছু ঐতিহাসিক বলেছেন, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা ছিল সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া বা সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন, রজনীপাম দত্ত প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে একমত। লর্ড ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতির ফলে ঝাসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, পেশওয়ার দত্তকপুত্র নানাসাহেব তাঁদের রাজ্য হারান,সাতারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়, কুশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা রাজ্য ইংরেজরা দখল করে। নতুন ভূমিব্যবস্থায় এখানকার তালুকদাররা জমি হারায়। ফলে রাজ্যহারা রাজা-রানি, জমি হারা কৃষক,জমিদার তালুকদাররা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তারা ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহে অংশ নেয়।ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার-এর মতে, এই বিদ্রোহ ছিল ক্ষয়িষ্ণু অভিজাততন্ত্র ও মৃতপ্রায় সামন্তদের ‘মৃত্যুকালীন আর্তনাদ’।
অপরপক্ষে অধ্যাপক সুশোভন সরকার বলেন যে, নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ, হজরৎ মহল, কুনওয়ার সিং প্রমুখ। সামন্ত-জমিদার ও তালুকদারদের হাতে বিদ্রোহের নেতৃত্ব ছিল বলে এই বিদ্রোহকে কখনই সামন্ত বিদ্রোহ ও প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দেওয়া যায় না। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং তারাই ছিলেন সমাজের ‘স্বাভাবিক নেতা। এই কারণে এই অভ্যুত্থানও সামন্ত-প্রভাবিত হওয়া স্বাভাবিক ছিল। তার মতে, অভ্যুত্থান জয়যুক্ত হলে তা রক্ষার জন্য সামন্ত-প্রভাব মুক্ত নতুন শক্তির, নতুন কৌশলের ও নতুন সংগঠনের আবির্ভাব ঘটত। তিনি বলেন যে, সামন্তব্যবস্থার স্তম্ভস্বরূপ রাজন্যবর্গের একজনও বিদ্রোহে যোগ দেননি এবং অযোধ্যার বাইরে জমিদারদের অধিকাংশই ছিলেন ইংরেজদের পক্ষে। বিদ্রোহে যোগদান করা দুরে থাক—প্রকৃত সামন্ত নেতৃবৃন্দ বিদ্রোহ বানচাল করতেই ব্যস্ত ছিলেন। সুতরাং এই বিদ্রোহকে কখনই সামন্ত বিদ্রোহ বলা যায় না।
যাইহোক ঐতিহাসিক পি. সি. যোশী নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে রুশ-সামন্ত, ইতালির ঐক্য আন্দোলনে মাৎসিনী, গ্যারিবল্ডি, ক্যাভুর ও ভিক্টর ইম্যানুয়েলের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন যে, বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে সামন্তদের গৌরবজনক ভূমিকা থাকলেও ভারত ইতিহাসেও তাদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। তার মতে, সামন্ত-নেতৃত্বে পরিচালিত হলেও ১৮৫৭-র বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে জাতীয় সংগ্রাম।
প্রশ্নমান ---8 (৮)
প্রশ্নঃ 1857 সালের সিপাহী বিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র আলোচনা কর ।
উত্তর:
1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ইতিহাসে সিপাহি বিদ্রোহ, মহাবিদ্রোহ, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রভৃতি বিভিন্ন নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ যুক্তি সহকারে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সিপাহি বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মতামত বিশ্লেষণ করলে যে দৃষ্টিকোণগুলি সামনে আসে সেগুলি নীচে আলোচনা করা হল-
সিপাহি বিদ্রোহ: বেশকিছু ঐতিহাসিক ও চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ মনে করেন যে, 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ছিল নিছক সিপাহিদের বিদ্রোহ। রবার্টস, জন কে, জন সিলি এবং দাদাভাই নওরোজি, রাজনারায়ণ বসু, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ আহমেদ খান প্রমুখ এই মতের সমর্থক।ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার ‘History of Freedom Movement in India” গ্রন্থে অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। কিশোরী চাাঁদ মিত্র বলেছেন “এই বিদ্রোহ ছিল একান্তভাবেই সিপাহিদের বিদ্রোহ। এতে গণ আন্দোলনের কোনো উপাদান ছিল না।”
সিপাহি বিদ্রোহ বলার যুক্তিগুলি হল-
১) 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ সিপাহিদের জন্য এবং সিপাহিদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল।
২)দেশীয় রাজশক্তির অধিকাংশই হয় এই বিদ্রোহে নিরপেক্ষ ছিল নতুবা সিপাহিদের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল।
৩) শিক্ষিত ও সাধারণ মানুষ এই বিদ্রোহ থেকে দূরে ছিল।
বিপক্ষে যুক্তি:
এই বিদ্রোহকে নিছক সিপাহী বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত করা যুক্তিসঙ্গত নয়। অনেকেই সিপাহি বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলতে অধিক পছন্দ করেন। ঐতিহাসিক হোমস, ডাফ, ম্যালেসন,জে.বি, নর্টন, আউট্রাম এবং ডিসরেলি এই বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলেছেন। সমাজতন্ত্রবাদের জনক কার্ল মার্কসও একে জাতীয় বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেছেন।
জাতীয় বিদ্রোহ ::
১) এই বিদ্রোহ সিপাহিরা শুরু করলেও অচিরেই বিভিন্ন স্থানের অসামরিক ব্যক্তিবর্গ এতে যোগ দিয়েছিল।
২) বিদ্রোহীরা সিংহাসনচ্যুত শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে বিদ্রোহে ঝাপিয়ে পড়েছিল।
3) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয়তাবোধের সঙ্গে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মিশে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়। সেদিক থেকে সিপাহি বিদ্রোহে প্রায় সমগ্র ভারতবাসী ব্রিটিশ শোষণ থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য যোগ দিয়েছিল । তাই একে জাতীয় বিদ্রোহ বলাই যুক্তিযুক্ত।/তাই একে সিপাহি বিদ্রোহ না বলাই শ্রেয়।
জাতীয় বিদ্রোহ না বলার যুক্তিঃ-
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলা যায় না, কারণ—(১) বিদ্রোহীদের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, পরিকল্পনা বা সংগঠন ছিল না।
(২) ঐক্য বা বোঝাপড়া কেবলমাত্র সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
(৩) সিপাহিদের সঙ্গে বিদ্রোহী নেতাদের তেমন যোগাযোগ ছিল না।
(৪) বিদ্রোহের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও নেতাদের মধ্যে লক্ষ্য ও আদর্শের ফারাক ছিল। জাতীয় স্বার্থে বিদ্রোহ পরিচালিত হয়নি।।
প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম ::
বিনায়ক দামোদর সাভারকার তার Indian War of Independence গ্রন্থের সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে উল্লেখ করেছেন।
পক্ষে যুক্তিঃ
(১) ইংরেজ কোম্পানির দীর্ঘকালের শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ ছিল ভারতবর্ষের বুকে জনগণের জ্বলন্ত প্রতিবাদ।
(২) বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে চেয়েছিল।
(৩) ১৮৫৭-সালের বিদ্রোহ সমগ্র ভারতে না হলেও এমনকি এর কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য না থাকলেও অধিকাংশ ভারতীয়ই মনেপ্রাণে ইংরেজদের বিতাড়ন চেয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক এক সঙ্গে লড়েছিল এবং দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট করেছিল।
(৪) ইংরেজ-বিরোধী এত ব্যাপক আন্দোলন ভারতে আর হয়নি। তাই গতানুগতিক বিচার না করে এই অভূখানকে স্বাধীনতার সংগ্রাম বলাই যুক্তিযুক্ত।
বিপক্ষে যুক্তি : ডা. রমেশচন্দ্র মজুমদার ও সুরেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেননি,কারণ-
(১) তাদের মতে, ভারতের কিছু অঞ্চলে এই বিদ্রোহ সীমাবদ্ধ ছিল; কাজেই এই সংগ্রামকে সারা ভারতের সংগ্রাম বলা যায় না।
(২) এই বিদ্রোহ ছিল সিপাহিদের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ, যা জাতীয় বিদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে না।
(৩) অধিকাংশ সামন্তরাজ ও জমিদার ইংরেজ কোম্পানির প্রতি অনুগত ছিল এবং বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল।
৪) বিদ্রোহীরা সকলের স্বাধীনতা লাভের জন্য নয়, বরং পৃথক পৃথক উদ্দেশ্য সিদ্ধির লক্ষ্যে বিদ্রোহ করেছিল।
(৫) শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজও সমসাময়িক বাংলার পত্রপত্রিকাগুলিও বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল।
৬) তখন বিদ্রোহীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের চেতনা ছিল না অর্থাৎ সেই সময় জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়নি।
উপসংহারঃ-এই বিদ্রোহকে নিছক সিপাহি বিদ্রোহ,সামন্ত বিদ্রোহ বা সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ বলে অভিহিত করা ঠিক হবে না। কেবল ধর্মীয় কারণ বা এনফিল্ড রাইফেলের টোটার জন্যই এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়নি। এই বিদ্রোহ হল মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ছিল সাধারণ মানুষ। বাহাদুর শাহ,নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ প্রমুখ নেতৃবৃন্দকে তারা বিদ্রোহে যোগ দিতে বাধ্য করে। নানা ত্রুটি, নানা গোলযোগ, নানা বিদ্বেষ সত্ত্বেও এই বিদ্রোহের গণ-চরিত্রকে কখনই অস্বীকার করা যায় না বা একে স্বাধীনতা সংগ্রাম বললেও অত্যুক্তি হয় না। যাইহোক এই বিদ্রোহকে কোনো বিশেষ একটি মত দিয়ে বিশ্লেষণ করলে এর সঠিক চরিত্র বোঝা যাবে না,তাই কোনো একটি বিশেষ মত যেমন পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি আবার ভিত্তিহীনও নয়। প্রত্যেক মতামতের পেছনে কিছু না কিছু সত্য লুকিয়ে আছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন