উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ
ভুমিকাঃ রেনেসাঁস একটি ফরাসি শব্দ। এর বাংলা অর্থ হল নবজাগরণ। রেনেসাঁস শব্দটি ইউরোপে বিশেষত ইটালির ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। এই শব্দের দ্বারা মূলত ১৪-১৬ শতকের ইতালীয় সাহিত্য, শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও রাজনীতির স্ফুরণকে বোঝায়। অপদিকে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে উনিশ শতকের মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে এক যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী আড়োলনের সুচনা হওয়ার ফলে তৎকালীন ধর্ম,সমাজ,শিক্ষা,সাহিত্য,দর্শন,রাজনীতি-জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ব্যাপক পরিবর্ত্ন পরিলক্ষিত হয়, যাকে ঐতিহাসিকরা ‘বঙ্গীয় নবজাগরণ’ বা ‘Bengal Renaissance’ বলে অভিযোগ করেছেন।
নবজাগরণের স্রষ্টাঃ নবজাগরণের স্রষ্টা কারা তা নিয়ে বিতর্ক আছে।পশ্চিমের জ্ঞান-বিজ্ঞান,যুক্তিবাদ,দর্শন,মানবতাবাদ,উদারনীতি প্রভৃতি বাঙালি মনোজগতে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছিল আর এই পরিবর্তনের ফলে নবজাগরণের সূত্রপাত হয়েছিল।বাংলার নবজাগরণের অন্যতম দিকছিল হিন্দু ধর্মের সংস্কার সাধন।রাজা রামমোহন রায়,দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতা, পুরোহিততন্ত্র ও আচারসর্বস্বতাকে দূর করতে চেয়েছিলেন। মার্কিন গবেষক ডেভিড কফ মনে করেন যে, উইলিয়াম জোন্স,জোনাথন ডানকান এবং কোলব্রুকের মত ব্যক্তিদের প্রচেষ্টাতেই বাংলায় নবজাগরণ ঘটেছিল।তিনি আরো মনে করেন,বাংলার নবজাগরনে এশিয়াটিক সোসাইটি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রভূতি প্রতিষ্ঠান বিশেষ ভূমিকা ছিল।যাইহোক রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেন যে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে দেশবাসীর অভ্যন্তরে মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদের স্ফুরোন ঘটে এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবধারার সমন্বয়ের ফলে নবজাগরণের সূচনা হয়। ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী বলেন যে, পশ্চিম ও পূর্বের বীজের শংকর ভারতের মাটিতে পড়ে যে ফসল ফলিয়েছে তাই হলো নবজাগরণের ভিত্তি।
বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ও প্রকৃতি: উনিশ শতকে বাংলাদেশের নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি বিষয়ে বিভিন্ন মতামত আছে।
বাংলার নবজাগরণ : রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কেশব চন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উনিশ শতকে বাংলার বৌদ্ধিক অগ্রগতি ও সংস্কার আন্দোলনের বিস্তার ইত্যাদির কারণে একে নবজাগরণ বলেই অভিহিত করেন।
ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার তার ‘বাংলার ইতিহাস' গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলাকে নবজাগরণের পীঠস্থান’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, “কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর ইউরোপে যে নবজাগরণ দেখা যায়, উনবিংশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল তার থেকেও ব্যাপক, গভীর এবং বৈপ্লবিক।”
অধ্যাপক সুশোভন সরকার বলেছেন যে, বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শাসনে বুর্জোয়া অর্থনীতি ও আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব অনুভূত হয়। তার ফলে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটে তাকে সাধারণভাবে নবজাগরণ বলা হয়ে থাকে। ইউরোপীয় নবজাগরণের সেই ভূমিকা পালন করেছিল বাংলা ।
বাংলার নবজাগরণ প্রকৃত নবজাগরণ নয় : অনেকে বাংলার নবজাগরণের কথা স্বীকার করলেও একে প্রকৃত অর্থে নবজাগরণ বলতে রাজি নন।
তথাকথিত নবজাগরণঃ প্রখ্যাত পণ্ডিত অশোক মিত্র ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে আদমশুমারি বা Census তৈরির সময় বাংলায় উনিশ শতকের জাগরণকে “তথাকথিত নবজাগরণ” (so called Renaissance) বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে নয়া জমিদারশ্রেণি সাধারণ রায়তদের শোষণ করে যে বিপুল অর্থ লাভ করেছিল তার একটা বিরাট অংশ তারা কলকাতার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করেছিলেন। এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনও যোগ ছিল না।
ইউরোপীয় নবজাগরণের সমতুল্য নয় : গবেষক সুপ্রকাশ রায় বলেছেন, বাংলায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল ইউরোপের আন্দোলন থেকে ভিন্ন এবং বিপরীতমুখী। তিনি বলেছেন, আমাদের আধুনিক যুগের লেখকগণ ইউরোপের অনুকরণে সোহাগভরে বাংলার নগরকেন্দ্রিক আন্দোলনটির নাম দেয় নবজাগরণ। ইউরোপের নবজাগরণ ছিল সামন্তপ্রথার বিরুদ্ধে; কিন্তু বাংলার নবজাগরণ ছিল জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের সাথে একত্রিত হয়ে সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামীদের আন্দোলন।আবার বাংলার বিশাল কৃষকশ্রেণি ছিল ভূস্বামীদের শত্রু ও বিরোধী।
ঐতিহাসিক প্রতারণাঃ ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষ তার ‘বাংলার নবজাগৃতি’ গ্রন্থে বলেছেন উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ ছিল একটি মিথ্যাচার।নবজাগরণ কে তিনি একটি ঐতিহাসিক প্রতারণা বলে অভিযোগ করেছেন। অরবিন্দ পোদ্দার, ডঃ বরুন দে, ডঃ অশোক সেন এবং সুমিত সরকারও ঠিক অনুরূপ বক্তব্য রেখছেন। অরবিন্দ পোদ্দার এর মতে উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ ছিল ‘একটি বিকৃত ও নীরস নবজাগরণ’
নবজাগরণ এর সীমাবদ্ধতা : বাংলার নবজাগরণে ইতালিয় নবজাগরণের প্রকৃতি নবজাগরণ বলা যায়না। কারণ বাংলার নবজাগরণের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল এগুলি হল-------------
১.বাংলার নবজাগরণের ব্যক্তি ছিল খুবই সীমিত। এটি মূলত কলকাতা শহর কেন্দ্রিক ছিল। গ্রাম বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এর কোন সুফল পায়নি।
২.এটি ছিল মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিত মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই ডঃ অনিল শীল এই আন্দোলনকে এলিটিস্ট আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন।
৩.উনিশ শতকের নবজাগরণের সমাজ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলন ছিল মূলত হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই একে হিন্দু নবজাগরণ বলা হয়। মুসলমান সম্প্রদায় ও নিম্ন বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়েনি।
৪.নবজাগরণের নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ছিলেন অতিমাত্রায় শ্রদ্ধাশীল।তারা মনে করতেন ব্রিটিশ শাসনের দাড়ায় ভারতবাসীর করলেন সম্ভব। ব্রিটিশ সংস্কৃতিতে মোহগ্রস্ত নবজাগরণের নেতৃবৃন্দ ভারতীয় সভ্যতার সমস্ত কিছুতেই দোষ দেখতেন।
উপসংহার : বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ এর গুরুত্ব কোন অংশে কম ছিলনা। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে নবজাগরণের সঙ্গে উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের যথেষ্ট পার্থক্য থাকলেও এর ফলে বাংলা তথা ভারতের সমাজ,ধর্ম ,শিক্ষা, সাহিত্য ,রাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে যা নবভারত এর আবির্ভাব ত্বরান্বিত করে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন