ব্রাম্ভ আন্দোলন



ভূমিকা:

উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতের ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিল ব্রাহ্রসমাজ। ব্রাহ্রসমাজ একেশ্বরবাদের কথা প্রচার করে। রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে ব্রাহ্রসমাজ গঠিত হয়; কিন্তু পরবর্তীকালে এর বিবর্তন ও বিভাজন ঘটে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে আদি ব্ৰাহ্মসমাজ, কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্বসমাজ’,নববিধান ব্রাহ্রসমাজ’ এবং শিবনাথশাস্ত্রী ও আনন্দমোহন বসুর নেতৃত্বে সাধারণ ব্রাহ্রসমাজ গড়ে ওঠে।

ব্রাক্মসমাজ প্রতিষ্ঠা:- রাজা রামমোহন রায় উপনিষদের একেশ্বরবাদী তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে 1828 খ্রিস্টাব্দে ব্রাত্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি পরবর্তীকালে(1830 খ্রিস্টাব্দে ) ব্রাহ্রসমাজ নামে পরিচিত হয়।

 প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য : রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাম্মসমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল—

a. এক ও অদ্বিতীয় ব্রত্মের উপাসনা করা।

b. খ্রিস্টান মিশনারিদের আক্রমণের হাত থেকে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করা।

c. বাংলায় বৈদান্তিক হিন্দুধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

d. হিন্দুধর্মের নামে যেসব কুসংস্কার ও অন্যায়-অবিচার প্রচলিত আছে তার উচ্ছেদ করা।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর::

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ব্রাত্যসমাজে বিবর্তন: রাজা রামমোহনের মৃত্যুর পর ব্রাহ্রসমাজ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যোগদানের ফলে ব্রাত্ম আন্দোলনে নতুন প্রাণের সাঞ্চার হয় এবং ব্রাহ্ম সমাজ আবার গতিশীল ওঠে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সবচেয়ে বড় অবদান হল তিনি ব্রাহ্রসমাজের নিয়মাবলি, ধর্ম, আচারবিধি, ক্রিয়াপদ্ধতি প্রভৃতি প্রণয়ন করেন। তার এই কাজের ফলে ব্রাত্য আন্দোলন একটি সাংগঠনিক রূপ পায়। তিনি ব্রাত্মধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হন। যাইহোক ব্রাম্মসমাজ সাংগঠনিক রূপ লাভ করার পর ব্রহ্মরা একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ে পরিণত হয় এবং তিনি বেদের অভ্রান্ততা অস্বীকার করার ফলে হিন্দুধর্মের সঙ্গে ব্রাত্মধর্মের দূরত্ব বাড়তে থাকে।

কেশবচন্দ্র সেন::

কেশবচন্দ্র সেন ও ব্রাম্মসমাজের বিবর্তন:-1857 খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্রসমাজে যোগদান করলে ব্রাত্ম আন্দোলন আরও গতিশীল হয়। তার বাগ্মিতা, ধর্মোন্মাদনা ও নিষ্ঠায় মুগ্ধ শিক্ষিত যুবকরা দলে দলে ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করে। তার সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর 1862 খ্রিস্টাব্দে তাকে ‘ব্ৰত্মানন্দ’ উপাধি দেন। তিনি ব্রাহ্বসমাজের সম্পাদক ও আচার্য হন।1865 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় 50টি এবং সারা ভারতে মোট 54টি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।

ব্রাহ্ম সমাজের বিভাজনঃ-

A. ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ও আদি ব্রাহ্মসমাজ : কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্ম উপাসনা পদ্ধতি ও ব্রাহ্মধর্মের মূল তত্ত্বগুলিকে সহজসরল ও যুগোপযোগী করে তোলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতেন ব্রাহ্ম ধর্ম হল হিন্দুধর্মই এবং হিন্দুধর্মের বিশুদ্ধ রপ। তিনি মূর্তিপূজা অথবা হিন্দুধর্মের অন্য কোন সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন না। অপরদিকে কেশবচন্দ্র সেন কেশবচন্দ্র সেন হিন্দুধর্ম ও সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধেও আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন। এই মতপার্থক্যের জন্য ব্রাহ্ম সমাজ ভেঙে যায়। কেশবচন্দ্র সেন 1866 খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্বসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁর অনুগামীদের ব্রাহ্মসমাজ ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিতি লাভ করেন।

B. সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ:-কিছুদিনের মধ্যে ভারতবর্ষীয় ব্রাম্মসমাজের মধ্যে বিভেদ ঘটে। কেশবচন্দ্রের চৈতন্যপ্রীতি, খ্রিস্টপ্রীতি, হিন্দু দেবদেবী ও অনুষ্ঠানের প্রতি বিশ্বাস ব্রাহ্ম সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তিনি বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করলেও নিজের 14 বছর বয়সি কন্যা সুনীতিদেবীর সঙ্গে কোচবিহারের নাবালক রাজপুত্র নৃপেন্দ্রনারায়ণের বিবাহ দিলে তরুণ ব্রাহ্মরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তরুণ ব্রাহ্মনেতা শিবনাথ শাস্ত্রী,আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় 1878 খ্রিস্টাব্দের 15 মে ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন।

C. নববিধান ব্ৰাহ্ম সমাজ :- কেশবচন্দ্র সেন 1880 খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিখ্যাত নববিধান প্রচার করেন। এর মাধ্যমে তিনি সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শ প্রচার করেন। কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে পরিচালিত ব্রাহ্ম সমাজ ‘নববিধান ব্রাত্মসমাজ’ নামে পরিচিত হয়।

 ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রভাব:- উনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনে ব্রাহ্মগণ সার্থক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । সমাজ সংস্কার, ধর্ম সংস্কার এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বার্হ্ম সমাজের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় । স্বয়ং রামকৃষ্ণ দেবও এই ধর্মকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন । স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম জীবনে এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন । পর্দাপ্রথার বিলুপ্তি সাধন, বিধবাবিবাহ প্রথার প্রচলন, বহুবিবাহ প্রথার নিষিদ্ধকরণ, নারীজাতির মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রচলন, সতীদাহ নিবারণ প্রভৃতি নারীকল্যাণ মূলক সমাজ সংস্কারের কাজ করে ব্রাহ্মসমাজ সমসাময়িককালের হিন্দু সমাজের বিশেষ করে ভারতীয় নারীদের সামাজিক অবস্থানের সামগ্রিক উন্নতি সাধন করে গেছেন । 

উপসংহারঃ- কেশবচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত ব্রাহ্ম সমাজ তার প্রভাব-প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলে। তবে বাংলার ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, “কেশবচন্দ্র পরিচালিত এই ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনই হল প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন।”

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

দশম শ্রেণীর ইতিহাস :: প্রথম অধ্যায়

দশম শ্রেণীর ইতিহাস ( পঞ্চম অধ্যায়)

দশম শ্রেণীর ইতিহাস ( তৃতীয় অধ্যায়)