দশম শ্রেণীর ইতিহাস ( তৃতীয় অধ্যায়)




  অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর::  ১ নম্বরের জন্য 

১) ব্রিটিশ ভারতে মোট কতগুলি অরণ্য আইন পাশ হয়েছিল?

👉 তিনটি-1865, 1878 ও 1927 খ্রিস্টাব্দে।

২) ভারতে কবে প্রথম অরণ্য আইন পাশ হয়?

👉 1865 খ্রিস্টাব্দে।

৩)1878 খ্রিস্টাব্দে অরণ্য আইনে অরণ্যকে কয় ভাগে ভাগ করা হয়েছিল?

👉 তিন ভাগে (সংরক্ষিত অরণ্য, সুরক্ষিত অরণ্য, গ্রামীণ অরণ্য)।

৫)কবে কার নেতৃত্বে প্রথম চুয়াড় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল?

👉 1768,-69 খ্রিস্টাব্দে ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহের নেতৃত্বে।

৬) 1798-99 খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত চুয়াড় বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্যায়ে কারা নেতৃত্ব দিয়েছিল?

👉 দুর্জন সিংহ, অচল সিংহ, মাধব সিংহ প্রমুখ।

৭) মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও ধলভূমের স্থানীয় জমিদারদের অধীনে রক্ষী বাহিনীর কাজ করে জীবিকা নির্বাহকারী চুয়াড়দের কি বলা হতো?

👉পাইক।

৮)জঙ্গলমহল জেলা কবে গঠিত হয়?

👉1800 খ্রিস্টাব্দে।

৯)কোন কোন অঞ্চল নিয়ে জঙ্গলমহল জেলা গঠিত হয়েছিল?

👉 মেদিনীপুর, বাঁকুড়া,মানভূম বীরভূম প্রভৃতি।

১০)) গোবর্ধন দিকপতি কোন বিদ্রোহের নেতা ছিলেন?

👉 চুয়াড় বিদ্রোহের।

১১)) চুয়াড় শব্দের অর্থ কি?

👉 দুর্বৃত্ত ও নীচজাতি।

১২)মেদিনীপুরের লক্ষীবাঈ কাকে বলা হয়?

👉 রানী শিরোমণি।

১৩) ভারতে বন বিভাগ বা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট কবে স্থাপিত হয়?

👉 1864 খ্রিস্টাব্দে।

১৪) ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিসের প্রধান উদ্যোক্তা কে ছিলেন?

👉ডায়াট্রিক ব্রান্ডিস।

১৫)ডায়াট্রিক ব্রান্ডিস কে ছিলেন?

👉 জার্মান বন বিশেষজ্ঞ।

১৬) কোন শব্দ থেকে চুয়াড় বা চুয়ার শব্দের উৎপত্তি হয়েছে?

👉চার।

১৭) বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কে কবে প্রবর্তন করেন?

👉1793 খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিস।

১৮) পাইক বা সৈনিকের কাজ করে চুয়াররা বেতনের পরিবর্তে যে নিষ্কর জমি ভোগ করত, তাকে কি বলা হয়?

👉 পাইকান।

১৯) ভারতের প্রথম ফরেস্ট ইন্সপেক্টর কে ছিলেন?

👉ডায়াট্রিক ব্রান্ডিস।

২০) রিজার্ভ ফরেস্ট অ্যাক্ট বা সংরক্ষিত অরণ্য আইন কবে পাস হয়?

👉 1878 খ্রিস্টাব্দে।

২১) কবে কার নেতৃত্বে রংপুর বিদ্রোহের সূচনা হয়?

👉 1783 খ্রিস্টাব্দের 18ই জানুয়ারি, নুরুলুদ্দিন।

২২) কোন গ্রামে রংপুর বিদ্রোহের সূচনা হয়?

👉তেপা গ্রামে।

২৩) রংপুর বিদ্রোহের কয়েকজন নেতার নাম লেখ?

👉 নুরুলুদ্দিন, নন্দরাম, সুফদিল, ধীরাজরঞ্জন প্রমূখ।

২৪) কার বিরুদ্ধে রংপুর বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল?

👉 দিনাজপুর ও রংপুরের ইজারাদার দেবী সিং এর বিরুদ্ধে।

২৫) রংপুর বিদ্রোহীরা কাকে তাদের নবাব বলে ঘোষণা করেছিলেন?

👉 নুরূলদ্দিন-কে

২৬) রংপুর বিদ্রোহের সময় রংপুরের কালেক্টর কে ছিলেন?

👉 গুডল্যান্ড।

২৭) অরন্যের সন্তান কাদের বলা হয়?

👉 কোল ও তাদের সমগোত্রীয় মুন্ডা ওঁরাও প্রভৃতি উপজাতিদের অরন্যের সন্তান বলা হয়।

২৮) কোলরা কোথায় বসবাস করত?

👉 ছোটনাগপুর, রাঁচি ও সিংভূম অঞ্চলে।

২৯) কোল বিদ্রোহ কবে সংঘটিত হয়েছিল?

👉1831-32 খ্রিস্টাব্দে।

৩০) ইংরেজরা কবে ছোটনাগপুর ও সিংভূম দখল করে?

👉 1830 খ্রিস্টাব্দে।

৩১) কোল বিদ্রোহের কয়েকজন নেতার নাম লেখ?

👉 বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত, সুই মুন্ডা, বিন্দ্রাই মানকি প্রমূখ।

৩২) কোল বিদ্রোহে কোল ছাড়া আর কোন কোন উপজাতি যোগদান করেছিল?

👉হো, মুন্ডা, ওঁরাও প্রভৃতি।

৩৩) দিকু শব্দের অর্থ কি?

👉 বহিরাগত।

৩৪) সুই মুন্ডা কোন বিদ্রোহের নেতা ছিলেন?

👉 কোল বিদ্রোহের।

৩৫) কোল বিদ্রোহ কে কবে দমন করেন?

👉1832 খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন উইলকিন্স।

৩৬) দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি কবে গঠিত হয়?

👉1833 খ্রিস্টাব্দে।

৩৭) সাঁওতাল বিদ্রোহ কবে সংঘটিত হয়েছিল?

👉 1855 56 খ্রিস্টাব্দে।

৩৮) সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রতীক কি ছিল?

👉 শাল গাছ।

৩৯) দামিন-ই-কোহ শব্দের অর্থ কি?

👉 পাহাড়ের প্রান্তদেশ।

৪০) সাঁওতালি ভাষায় সাঁওতাল বিদ্রোহকে কি বলা হয়?

👉 খেরওয়ারি হুল।

৪১) "হুল" শব্দের অর্থ কি?

👉 বিদ্রোহ।

৪২) কবে এবং কোথায় সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হয়?

👉 1855 খ্রিষ্টাব্দের 30 শে জানুয়ারি, ভাগনাডিহির মাঠে।

৪৩) সাঁওতাল বিদ্রোহের কয়েকজন নেতার নাম লেখ।

👉 সিধু,কানু, চাঁদ,ভৈরব,  বীর সিং, কালো প্রামানিক,ডোমন মাঝি প্রমুখ।

৪৪) সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় ভারতের গভর্নর জেনারেল কে ছিলেন?

👉 লর্ড ডালহৌসি।

৪৫) কোন ইংরেজ সেনাপতি সাঁওতালদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন?

👉 মেজর বরোজ।

৪৬) নৈকদা আন্দোলন কবে কোথায় সংঘটিত হয়েছিল?

👉1868 খ্রিস্টাব্দে গুজরাটে।

৪৭) মুন্ডা বিদ্রোহ কবে সংঘটিত হয়েছিল?

👉1899-1900 খ্রিস্টাব্দে।

৪৮) মুন্ডা শব্দের আক্ষরিক অর্থ কি?

👉 গ্রাম প্রধান।

৪৯) বেট বেগারি প্রথা কোন বিদ্রোহের সঙ্গে সম্পর্কিত?

👉 মুন্ডা বিদ্রোহ।

৫০) বেড বেগারির অর্থ কি?

👉 বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমদান।

৫১) মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান নেতা কে ছিলেন?

👉 বিরসা মুন্ডা।

৫২) বিরসা মুন্ডার বাবার নাম কি?

👉 সুগান মুন্ডা।

৫৩) খুৎকাঠি প্রথা কোন বিদ্রোহের সঙ্গে সম্পর্কিত?

👉 মুন্ডা বিদ্রোহ।

৫৪) বিরসা মুন্ডা কবে কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?

👉 1875 খ্রিস্টাব্দে, রাঁচি জেলার উলিহাতু গ্রামে।

৫৫) কে নিজেকে ধরতি আবা বলে ঘোষণা করেছিলেন?

👉 বিরসা মুন্ডা।

৫৬) ধরতি আবা শব্দের অর্থ কি?

👉 ধরণীর পিতা।

৫৭) বিরসা মুন্ডা কোন দেবতার উপাসনা করতেন?

👉শিংবোঙা বা সূর্য দেবতা।

৫৮) মুন্ডাদের ভাষায় মুন্ডা বিদ্রোহকে কি বলা হয়?

👉 উলগুলান।

৫৯) উলগুলান শব্দের অর্থ কি?

👉 ভয়ঙ্কর বিশৃংখলা।

৬০) খুৎকাঠি শব্দের অর্থ কি?

👉 জমির যৌথ মালিকানা।

৬১) বিরসা মুন্ডার সেনাপতির নাম কি?

👉 গয়া মুন্ডা।

৬২) মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান কেন্দ্র কোথায় ছিল?

👉খুঁটি।

৬৩) সইল রাকার পাহাড়ের যুদ্ধ কবে কাদের মধ্যে হয়েছিল?

👉1900 খ্রিস্টাব্দের 9 জানুয়ারি, ইংরেজদের সঙ্গে মুন্ডাদের।

৬৪) ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন কবে পাস হয়?

👉 1908 খ্রিস্টাব্দে।

৬৫)বেট বেগারি প্রথা কি?

👉 যে প্রথা অনুযায়ী জমিদার ও মহাজনরা বিনা মজুরিতে মুন্ডাদের বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে বাধ্য করতো,তাকে বেট বেগারি প্রথা বলে।

৬৬) খুৎকাঠি প্রথা কি?

👉 ছোটনাগপুর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গভীর জঙ্গল কেটে মুন্ডাদের পূর্বপুরুষরা বা খুন্তকাঠিদাররা যে জমি তৈরি করেছিল তাকে খুন্তকাঠি বা খুৎকাঠি বলা হয়। এই খুন্তকাঠি জমির উপর মুন্ডাদের যৌথ মালিকানাকে খুৎকাঠি প্রথা বলা হয়।

৬৭) তানা ভগৎ আন্দোলন কবে কোথায় সংঘটিত হয়?

👉 1914 খ্রিস্টাব্দে, ছোটনাগপুর অঞ্চলে।

৬৮) তানা ভগৎ আন্দোলনে কোন কোন সম্প্রদায় যোগদান করেছিল?

👉 তানা ভগৎ,ওঁরাও ও মুন্ডা সম্প্রদায়।

৬৯) তানা ভগৎ আন্দোলনের প্রধান নেতা কে ছিলেন?

👉 যাত্রা ভগৎ ও তুরিয়া ভগৎ।

৭০) রামসী বিদ্রোহ কবে কোথায় সংঘটিত হয়েছিল?

👉 1875 খ্রিস্টাব্দে, মহারাষ্ট্রে।

৭১)রামসী বিদ্রোহের প্রধান নেতা কে ছিলেন?

👉 বাসুদেও বলবন্ত ফাড়কে।

৭২) ভারতের সশস্ত্র বিপ্লববাদের জনক কাকে বলা হয়?

👉 বাসুদেও বলবন্ত ফাড়কে।

৭৩) ভিল বিদ্রোহ কবে কোথায় সংঘটিত হয়েছিল?

👉1819 খ্রিস্টাব্দে খান্দেশ অঞ্চলে।

৭৪) ভিলরা কোথায় বসবাস করত?

👉 পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পাদদেশের খান্দেশ অঞ্চলে।

৭৫) ভিল বিদ্রোহের কয়েকজন নেতার নাম লেখ।

👉 চিল নায়েক, তাঁতিয়া ভিল, হিরীয়া, শিউরাম প্রমুখ।

৭৬) সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ কবে সংঘটিত হয়েছিল?

👉 1763- 1800 খ্রিস্টাব্দে।

৭৭) কবে এবং কোথায় প্রথম সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সূচনা হয়?

👉 1763 খ্রিস্টাব্দে, ঢাকায়।

৭৮) সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলির নাম লেখ।

👉 ঢাকা, মালদহ, দিনাজপুর, রংপুর, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, কোচবিহার প্রভৃতি।

৭৯) সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের কয়েকজন নেতার নাম লেখ।

👉 ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী, মজনু শাহ, মুসা শাহ, পরাগল শাহ, চিরাগ আলী প্রমুখ।

৮০) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কোন কোন উপন্যাসে সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের বিবরণ আছে?

👉 আনন্দমঠ ও দেবী চৌধুরানী উপন্যাসে।

৮১) পাগলাপন্থী বিদ্রোহ কবে কোথায় সংঘটিত হয়েছিল?

  👉1825-27 খ্রিস্টাব্দে, ময়মনসিংহ জেলার শেরপুরে।

৮২) পাগলা পন্থার প্রতিষ্ঠাতা কে?

👉 ফকির করম শাহ।

৮৩) পাগলাপন্থী বিদ্রোহের দুজন নেতার নাম লেখ।

👉 ফকির করম শাহ ও তাঁর পুত্র টিপু।

৮৪) পাবনার কৃষক বিদ্রোহ কবে কোথায় সংঘটিত হয়েছিল?

👉1870 খ্রিস্টাব্দে, পাবনা জেলার ইউসুফশাহী পরগনার সিরাজগঞ্জে।

৮৫) পাবনা রায়ত সমিতি কবে কারা গঠন করেন?

👉 1873 খ্রিস্টাব্দে,পাবনার পাট চাষিরা।

৮৬) পাবনার কৃষক বিদ্রোহের কয়েকজন নেতার নাম লেখ।

👉 ঈশান চন্দ্র রায়, ক্ষুদি মোল্লা ও শম্ভুনাথ পাল।

৮৭) বিদ্রোহী রাজা কাকে বলা হয়?

👉 পাবনার কৃষক বিদ্রোহের নেতা ঈশান চন্দ্র রায় কে।

৮৮) কৃষ্ণদেব রায় কোথাকার জমিদার ছিলেন?

👉পুড়ার।

৮৯) ভারতে কে ফরাজি আন্দোলনের সূচনা করেন?

👉 হাজী শরীয়াতুল্লাহ।

৯০) ফরাজি আন্দোলন কবে সংঘটিত হয়েছিল?

👉 1818-1906 খ্রিস্টাব্দে।

৯১)"ফরাজী" শব্দের অর্থ কি?

👉 ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য।

৯২) ভারতে ফরাজি আন্দোলনের কয়েকজন নেতার নাম লেখ।

👉হাজী শরীয়াতুল্লাহ, দুধু মিঞা (মহম্মদ মহসিন),নোয়া মিঞা।

৯৩) ফরাজি আন্দোলনের বা দুদু মিঞার প্রধান কার্যালয় কোথায় ছিল?

👉 বাহাদুরপুর।

৯৪) কোন কোন স্থানে ফরাজি আন্দোলন বিস্তার লাভ করেছিল?

👉 ময়মনসিংহ, বাহাদুরপুর, বিক্রমপুর, যশোর, ত্রিপুরা, নদিয়া দক্ষিণ 24 পরগনা।

৯৫) ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষকে কে দার-উল-হার্ব বলেছেন?

👉 হাজী শরীয়াতুল্লাহ।

৯৬)"দার-উল-হার্ব" শব্দের অর্থ কি?

👉 বিধর্মীর দেশ বা শত্রুর দেশ।

৯৭) দার-উল-ইসলাম শব্দের অর্থ কি?

👉 ইসলামের পবিত্র ভূমি।

৯৮) অষ্টাদশ শতকে কে প্রথম ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করেন?

👉 আব্দুল ওয়াহাব।

৯৯) ভারতে কে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করেন?

👉 হাজী ওয়ালীউল্লাহ ও তাঁর পুত্র আজিজ।

১০০) "ওয়াহাবী" শব্দের অর্থ কি?

👉 নবজাগরণ বা পুনরুজ্জীবন।

১০১) ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা কাকে বলা হয়?

👉 রায়বেরেলির সৈয়দ আহমেদ।

১০২) ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র কোথায় ছিল?

👉 উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সিতানা।

১০৩) ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের কয়েকজন নেতার নাম লেখ?

👉 হাজী ওয়ালীউল্লাহ ও তাঁর পুত্র আজিজ, সৈয়দ আহমেদ, এনায়েত আলী, কেরামত আলী, তিতুমীর প্রমুখ।

১০৪)"পবিত্র কোরানে ফিরে যাও"-কে বলেছিলেন?

👉 রায়বেরেলির সৈয়দ আহমেদ।

১০৫)"তরিকা-ই-মহম্মদীয়া" শব্দের অর্থ কি?

👉 মহম্মদ নির্দেশিত পথ।

১০৬) কবে এবং কোন যুদ্ধে রায়বেরেলীর সৈয়দ আহমেদের মৃত্যু হয়?

👉1831 খ্রিস্টাব্দে, বালাকোটের যুদ্ধ।

১০৭) বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা কে ছিলেন?

👉 তিতুমীর।

১০৮) তিতুমীরের প্রকৃত নাম কি?

👉 মীর নিসার আলী।

১০৯)তিতুমীরের নেতৃত্বে কবে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল?

👉 1822-31 খ্রিস্টাব্দে।

১১০) বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র কোথায় ছিল?

👉 দক্ষিণ 24 পরগনার বারাসাত।

১১১) তিতুমীরের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলন আর কি কি নামে পরিচিত?

👉তরিকা-ই-মহম্মদীয়া ও বারাসাত বিদ্রোহ।

১১২)"তরিকা" শব্দের অর্থ কি?

👉পথ।

১১৩)"জেহাদ" শব্দের অর্থ কি?

👉 ধর্মযুদ্ধ।

১১৪) তিতুমীর কোথায় বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন?

👉 24 পরগনার নারকেলবেরিয়া গ্রামে।

১১৫) তিতুমীরের সেনাপতির নাম কি?

👉 গোলাম মাসুম।

১১৬) তিতুমীরের প্রধানমন্ত্রীর নাম কী?

👉মৈনুদ্দিন।

১১৭) কবে তিতুমীরের মৃত্যু হয়?

👉 1831 খ্রিস্টাব্দের 19 নভেম্বর।

১১৮) নীল বিদ্রোহ কবে সংঘটিত হয়েছিল?

👉 1859 খ্রিস্টাব্দে।

১১৯) বাংলায় কে এবং কবে প্রথম নীল চাষের উদ্যোগ নেন?

  👉 1777 খ্রিস্টাব্দে, লুই বোনার্ড নামক এক ফরাসি বণিক।

১২০) ভারতে কে প্রথম নীল শিল্প গড়ে তোলেন?

👉কার্ল ব্লুম।(হুগলিতে)

১২১) বাংলাদেশের একটি নীল উৎপাদনকারী সংস্থার নাম লেখ।

👉 বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি।

১২২) কোন আইনের দ্বারা ভারতে নীলচাষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার লুপ্ত হয়?

👉 1833 খ্রিস্টাব্দে সনদ আইনে।

১২৩) কোন কোন পত্রিকায় নীলকরদের অত্যাচারের ঘটনা লেখা হতো?

👉 হিন্দু প্যাট্রিয়ট, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, সমাচার দর্পণ, ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকা ইত্যাদি।

১২৪) কাকে নীল চাষির বন্ধু বলা হয়?

👉 হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

১২৫) কোথায় প্রথম নীল বিদ্রোহের সূচনা হয়?

👉 নদিয়ার কৃষ্ণনগরের চৌগাছা গ্রামে।

১২৬) পঞ্চম ও সপ্তম আইন কবে কেন  পাশ করা হয়?

👉 1830 খ্রিস্টাব্দে, নীলকরদের স্বার্থ রক্ষার্থে।

১২৭) কে কবে পঞ্চম আইন বাতিল করে দেন?

👉 1835 খ্রিস্টাব্দে,লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক।

১২৮) কাকে বাংলার রবিন হুড বলা হয়?

👉 বিশ্বনাথ সর্দার।

১২৯) কে বাংলার ইতিহাসে বিশেষ ডাকাত নামে পরিচিত?

👉 বিশ্বনাথ সর্দার।

১৩০) কবে এবং কার উদ্যোগে নীল কমিশন গঠিত হয়?

👉 1860 খ্রিস্টাব্দে বাংলার ছোটলাট জে.পি গ্রান্টের উদ্যোগে।

১৩১) 1860 খ্রিস্টাব্দে গঠিত নীল কমিশনের সদস্য কতজন ছিলেন?

👉 পাঁচজন।

১৩২) বাংলার নানাসাহেব কাকে বলা হয়?

👉 রামরতন মল্লিক।

১৩৩) নীল বিদ্রোহের কয়েকজন নেতার নাম লেখ?

👉 দিগম্বর বিশ্বাস, বিষ্ণুচরন বিশ্বাস, রফিক মন্ডল, কাদের মোল্লা, বিশ্বনাথ সর্দার, বৈদ্যনাথ সর্দার, মেঘাই সর্দার, রাম রতন মল্লিক, শ্রী গোপাল পালচৌধুরী, শ্রী হরি রায়, মথুরানাথ আচার্য প্রমূখ।

১৩৫) বাংলার ওয়াট টাইলার কাদের বলা হয়?

👉 দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরন বিশ্বাস।

১৩৬) রাজা দুর্জন সিংহ কোন বিদ্রোহের নেতা ছিলেন?

👉 চুয়াড় বিদ্রোহের।

১৩৭) ভারতের প্রথম ইন্সপেক্টর জেনারেল কে ছিলেন?

👉ড্রেইডিক ব্রান্ডিস।

১৩৮) সাঁওতাল বিদ্রোহকে কে নিম্ন শ্রেণীর গণবিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন?

👉 অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ।

১৩৯) কৃত্রিম নীল কবে আবিষ্কার হয়?

👉 1898 খ্রিস্টাব্দে।

১৪০) দাদন শব্দের অর্থ কি?

👉 অগ্রিম।

১৪১) বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন কবে পাস হয়?

👉 1885 খ্রিস্টাব্দে।

১৪১) রুম্পা বিদ্রোহ কোথায় হয়েছিল?

👉 অন্ধ্রের গোদাবরী উপত্যাকায়।

১৪২) রুম্পা বিদ্রোহের প্রধান নেতা কে ছিলেন?

👉 আল্লুরি সীতারাম রাজু।

১৪৩)M.L.L কার ছদ্মনাম?

👉 শিশির কুমার ঘোষ।

১৪৪) মুন্ডা অধ্যুষিত অঞ্চলে জঙ্গল পরিষ্কার করে তৈরি জমিকে কি বলা হত?

👉ভুঁইহারি।

১৪৫) মুন্ডা অধ্যুষিত অঞ্চলে জমিদারদের খাস জমিকে কি বলা হত?

👉মাঝিহাম।

১৪৭) সাঁওতালদের কাছ থেকে দ্রব্য কেনার সময় মহাজনদের ব্যবহৃত বেশি ওজনের বাটখারার নাম কি ছিল?

👉 কেনারাম।

১৪৮) সাঁওতালদের দ্রব্য বিক্রির সময় মহাজনদের ব্যবহৃত কম ওজনের বাটখারা নাম কি ছিল?

👉 বেচারাম।

১৪৯) হো বিদ্রোহ কবে কোথায় সংঘটিত হয়েছিল?

👉 1821 খ্রিস্টাব্দে ছোটনাগপুরের সিংভূম অঞ্চলে।


>>২ নম্বরের প্রশ্নোত্তর::


1.   খুৎকাঠি প্রথা কি?

খুৎকাঠি কথার অর্থ হল জমির যৌথ মালিকানা। এই প্রথা অনুযায়ী মুন্ডারা দীর্ঘদিন ধরে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে জমির যৌথমালিকানা ভোগ করত। কিন্তু ভারতে ব্রিটিশ শাসনের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসিদের পুরোনো ভুমিব্যবস্থার অবসান ঘটে এবং সেখানে জমি জরিপ ও ব্যাক্তিগত মালিকানার আবির্ভাব ঘটে।

2.   দাদন প্রথা বলতে কী বোঝো ?

দন কথাটির অর্থ হল অগ্রিম। রায়তি চাষ বা দাদনি চাষ বা বেএলাকা চাষ পদ্ধতিতে জমিতে নীল চাষের জন্য কৃষকদের বিঘা প্রতি 2 টাকা অগ্রিম বা দাদন দেওয়া হত। এর বিনিময়ে বাংলার কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করা হত। একবার দাদন নিলে তা কখনই পরিশোধ হতনা। আবার দাদন না নিলে চাষিদের গোরু-বাছুর ইত্যাদি নীলকুঠিতে আটকে রাখা হত। দীন-দরিদ্র, সহজ-সরল, কৃষকরা এতে সর্বস্বান্ত হয়।

3.   বারাসাত বিদ্রোহ কী? অথবা, কে, কী উদ্দেশ্যে বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন ?

জমিদার, নীলকর ও কোম্পানির কর্মচারিদের শাসন, শোষণ, অত্যাচার ও বাড়তি করের বিরুদ্ধে তিতুমির বিদ্রোহী হন। চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসাতের নারকেলবেড়িয়া গ্রামে তিনি একটি বাঁশেরকেল্লা বা দুর্গ নির্মাণ করে এর বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ ঘোষণা করেন। ইংরেজদের গোলায় তার বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয়। 1831 খ্রিস্টাব্দের 19 নভেম্বর যুদ্ধে তিনি নিহত হন। ইতিহাসে এটি বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

4.   বুদ্ধ ভগৎ কে ছিলেন? দামিন-ই কোহ কথার অর্থ কি ?

1831-32 খ্রিষ্টাব্দে বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চলে কোলরা যে বিদ্রোহ করেছিল তাদের অন্যতম নেতা ছিলেন বুদ্ধ ভগৎ

দামিন-ই-কোহ শব্দের অর্থ হল পাহাড়ের প্রান্তদেশ

5.   ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের উদ্দেশ্য কী ছিল ?

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন বলতে বোঝায় মহাবিদ্রোহের পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ভারতশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার পর চালু হওয়া অরণ্য আইনগুলিকে।

উদ্দেশ্যঃ a. ভারতে রেলপথ নির্মাণের উদ্দেশ্যে রেলের স্লিপার তৈরির জন্য কাঠ সংগ্রহ করা,

b. ইউরোপীয় যুদ্ধে জাহাজ নির্মাণের জন্য কাঠের জোগান সুনিশ্চিত করা, ও বনাঞ্চল থেকে রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করা এবং অরণ্যগুলির উপর ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করা।

6.   বিপ্লব বলতে কি বোঝায়?

বিপ্লব (Revolution) : বিপ্লব বলতে বোঝায় কোনোপ্রচলিত ব্যবস্থার অতি দ্রুত ও কার্যকরী পরিবর্তন। যখন কোনো দেশে পুরাতনতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এমনকি চিন্তার জগতে ব্যাপক ও সর্বাত্মক পরিবর্তন ঘটে তখন তাকে ‘বিপ্লব’ বলে। যেমন— ফরাসি বিপ্লব।

7.   মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্য কী ছিল?

মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্য ছিল স্বাধীন মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠা করা। মুন্ডাদের নিজস্ব জমি ব্যবস্থা খুঁকাঠি প্রথা, মুন্ডাদের নিজস্ব শাসন, আইন ও বিচারব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে সমদ্র মৃন্ডাসমাজকে বেগার শ্রমদান, শোষণ ও ধর্মান্তরিতকরণের হাত থেকে রক্ষা করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।

8.   নীল কমিশন কবে কেন গঠিত হয়?

1860 খ্রিস্টাব্দের 31 মার্চ নীল কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশন গড়ে তোলার উদ্দেশ্য ছিল নীলচাষিদের অভিযোগ ও বিক্ষোভ সম্পর্কে তদন্ত করা। সরকারি সদস্যদের নিয়েই মূলত এই কমিশন গঠিত হলেও কমিশন নীলকরদের বিরুদ্ধে আনা অধিকাংশ অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছিল।

9.   বিরসা মুন্ডা স্মরণীয় কেন?

মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান নেতা বিরসা মুন্ডা মুন্ডাদের দীর্ঘদিনের অরণ্য সম্পদের অধিকারের ওপর সরকারি বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ব্রিটিশরাজের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।তিনি বলেন বিদেশিদের বহিষ্কার না করলে কখনই স্বাধীনভাবে ধর্মচারণ করা সম্ভব নয়।অচিরেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ও মুন্ডাদের চোখে ভগবান রূপে পুজিত হতে থাকেন। 1900 খ্রিস্টাব্দে এই মহান নেতা মৃত্যুবরণ করেন।

10. তিন কাঠিয়া প্রথা কী?

বিহারের চম্পারণে নীলকর সাহেবরা চাষিদের বিঘা প্রতি (20 কাঠার মধ্যে তিন কাঠা অর্থাৎ 3/20 অংশ) জমিতে নীলচাষ ও নির্দিষ্ট দামে উৎপাদিত নীল নীলকর সাহেবদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য থাকত। এই ব্যবস্থাই তিনকাঠিয়া প্রথা নামে পরিচিত।

11.  ওয়াহাবি কথার অর্থ কি ভারতে কে এই আন্দোলনের সূচনা করেন?

ওয়াহাবি কথার অর্থ নবজাগরন। ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের সুচনা করেছিলেন দিল্লির বিখ্যাত মুসলিম সন্ত শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তার পুত্র আজিজ। শাহ ওয়ালিউল্লাহ এই আন্দোনের সুচনা করলেও ভারতে এই আন্দোলনের প্রকৃ ত প্রতিষ্ঠাতা হলেন উত্তর প্রদেশের রায় বেরিলির অধিবাসি সৈয়দ আহমেদ ব্রেল্ভি।

12. ফরাজী কথার অর্থ কি? ভারতে কে এই আন্দোলনের সূচনা করেন?

‘ফরাজি’ কথাটি এসেছে আরবি শব্দ ‘ফরাইজ’’ বা ‘ফরাইজ’ থেকে, যার অর্থ ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য। ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তন করেছিলেন হাজি শরিয়ত উল্লাহ (1781-1837 খ্রিস্টাব্দ)।

13. ফরাজি আন্দোলন কেন হয়েছিল?

উনিশ শতকে ভারতে মুসলমানদের মধ্যে কুসংস্কার, অনাচার দূর করে তাদেরকে পবিত্র ইসলামধর্মের অনুগামী করে তোলার জন্য হাজি শরিয়তউল্লাহ এক পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন গড়ে তোলেন। এটি ফরাজি আন্দোলন নামে পরিচিত। 1818 খ্রিস্টাব্দে থেকে 1906 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলেছিল।

14. সাঁওতাল বিদ্রোহের দুটি গুরুত্ব লেখ ?

সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর পরোক্ষ ফলাফল বা গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী।

গুরুত্বঃ-(i) এই বিদ্রোহের ভয়াবহতা লক্ষ্য করে সরকার তাদের প্রতি নমনীয় নীতি গ্রহণ করে, যেমন—সাঁওতালদের পৃথক উপজাতি রূপে স্বীকৃতিদান করে, সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে পৃথক ‘সাঁওতাল পরগনা’ গঠন করে, (ii) সাঁওতাল পরগনায় বাঙালি মহাজনসহ বহিরাগত দিকুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়, (ii) সরকার কর্তৃক সুদের হার নির্দিষ্ট কর হয়, (iv) সাঁওতাল পরগনাকে ব্রিটিশ আইনের প্রভাবমুক্ত করা হয়। (v) খ্রিস্টান মিশনারিদের সাঁওতালদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অবাধ সুযোগ দান করা ইত্যাদি।

15. বিদ্রোহ ও বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য কি?

                i.   বিদ্রোহ হলপ্রচলিত ব্যাবস্থার তীব্র বিরোধিতা করা। বিপ্লব বলতে বোঝায় কোনো প্রচলিল ব্যাবস্থার অতিদ্রুত ও কার্যকারী পরিবর্তন।

               ii.   বিদ্রোহ স্বল্প মেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে , অন্যদিকে বিপ্লব দীর্ঘস্থায়ী হয়।

              iii.   বিদ্রোহ যেমন- নীল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, রংপুর বিদ্রোহ, অন্যদিকে বিপ্লব যেমন- ফরাসি বিপ্লব, ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব।

16. বিরসা মুন্ডার উলগুলানো  বলতে কী বোঝো ?

 আদিবাসী শব্দ ‘উলগুলান’ কথাটির অর্থ হল ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলা’ বা ‘প্রবল বিক্ষোভ। বীরসা মুন্ডার নেতৃত্বে আদিবাসী মুন্ডারা 1899-1900 খ্রিস্টাব্দে ছোটনাগপুর ও তার সন্নিহিত অঞ্চলে যে-শক্তিশালী বিদ্রোহ শুরু করে তা উলগুলান নামে পরিচিত। মহাজন, জমিদার ও ইংরেজ কর্মচারীদের শোষণ ও অত্যাচার ইত্যাদি ছিল এই মুন্ডা উলগুলানের গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

17. চুয়াড় বিদ্রোহের দুটি বৈশিষ্ট্য লেখ ?

1898-99 খ্রিস্টাব্দে সংঘঠিত জঙ্গলমহলসহ মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সংঘঠিত হয় চুয়াড় বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের কতগুলি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।

বৈশিষ্ট্য : (i) চুয়াড়রা ছিল সশস্ত্র উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ। (i i) বিদ্রোহী চুয়াড় উপজাতিদের সাথে জমিদারগণও বিদ্রোহে  অংশগ্রহন করে।( i i i)এই বিদ্রোহ দুটি পর্যায়ে ঘটে।

18. বিদ্রোহ’ বলতে কী বোঝায়?

‘বিদ্রোহ’ বলতে বোঝায় নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলে প্রচলিত কোনো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো বা বিরোধিতা করা। এটি স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি, ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত, সশস্ত্র বা শান্তিপূর্ণ যে-কোনোভাবে হতে পারে।

উদাহরণ : ইংরেজ শাসনকালে ভারতে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এগুলির মধ্যে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ’ (1763 খ্রি:), রংপুর বিদ্রোহ (1783 খ্রি.), চুয়াড় বিদ্রোহ’ (1798 খ্রি.), নীল বিদ্রোহ (1859 খ্রি.), সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ’ (1763 খ্রি:), সাঁওতাল বিদ্রোহ (1855খ্রি.) প্রভৃতি ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

19. ‘বিপ্লব’ বলতে কী বোঝায়?

বিপ্লব’ বলতে কোন দেশের প্রচলিত ব্যবস্থা বা অবস্থার দ্রুত ও কার্যকরী পরিবর্তনকে  বোঝায়। এটি শান্তিপূর্ণভাবে অর্থাৎ বিনা রক্তপাতে হতে পারে কিংবা রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে হতে পারে। যেমনঃ- আমেরিকার বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব।

20. অভ্যুত্থান বলতে কী বোঝো?

কোনো দেশের প্রচলিত শাসনব্যবস্থা বা শক্তির বিরুদ্ধে একাংশের কিংবা সমষ্টির সশস্ত্র সংগ্রামকে বলা হয় অভ্যুত্থান। নিজেদের দাবিপূরণ বা ক্ষমতা দখলই এর প্রধান উদ্দেশ্য। 1857 খ্রিস্টাব্দের ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বা 1946 খ্রিস্টাব্দের নৌবিদ্রোহ হল অভ্যুত্থান-এর উদাহরণ।

21. চুয়াড় বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য গুলি লেখ?

a.   সশস্ত্র বিদ্রোহঃ-এই বিদ্রোহ ছিল একটি সশস্ত্র বিদ্রোহ এই বিদ্রোহ বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার হয় বলা হয় যে কর্নগড়ের রানী শিরোমণি ও নাড়াজালের রাজারা আড়াল থেকে গোলাবারুদ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেন।

b.    ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহঃ-চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ বিরোধী অভ্যুত্থান। অন্যান্য বিদ্রোহে কৃষকরা জমিদারদের ওপর ক্ষিপ্ত হয় কিন্তু এই বিদ্রোহ ছিল কৃষক ও জমিদারদের মিলিত ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।

c.   দীর্ঘস্থায়ী বিদ্রোহঃ-এই বিদ্রোহ ছিল একটি দীর্ঘস্থায়ী বিদ্রোহ 1768 1799 সাল পর্যন্ত প্রায় 30 বছর পর্যন্ত এই বিদ্রোহ চলেছিল।

22. অরণ্য আইন বলতে কী বোঝো?

ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর সরকার ভারতের অরণ্য সম্পদের ওপর নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কতগুলি আইন প্রণয়ন করেন। এগুলি ‘অরণ্য আইন’ নামে পরিচিত। এগুলির মধ্যে 1865,1878 ও 1927  খ্রিস্টাব্দের আইন উল্লেখযোগ্য। এতে একদিকে সরকারের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়, অন্যদিকে আদিবাসী সম্প্রদায় তাদের অধিকার হারায়।

23. কোল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য গুলি লেখ?

                   i.  কোল বিদ্রোহে আধিবাসি সম্প্রদায়ভুক্ত কোলদের কাছে বহিরাগত দিকু ও ইংরেজদের অত্যাচার থেকে মুক্তি ছিল স্বাধীনতা শামিল।

                   ii.  অরন্যের অধিকার রক্ষায় তারা একজোট হয়েছিল।

24. কেনারাম ও বেচারাম বলতে কী বোঝো?

‘কেনারাম’ ও ‘বেচারাম’ দু-ধরনের তারতম্য যুক্ত বাটখারা। ‘কেনারাম' নামক বাটখারা দ্বারা সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলের বহিরাগত ব্যবসায়ীরা সাঁওতালদের কাছ থেকে বেশি ওজনের বাটখারা দিয়ে কৃষিপণ্য ক্রয় করে তাদের ঠকাতো। আবার ‘বেচারাম’ নামক কম ওজনের বাটখারা দিয়ে তাদের বিভিন্ন দ্রব্য যেমন—চিনি, লবণ ইত্যাদি বিক্রি করা হত। এর ফলে দুভাবেই অসহায়, দরিদ্র সাঁওতালদের ঠকানো হত।

25. পাগলা পন্থী দের বিদ্রোহ কি?

1825-27 খ্রিস্টাব্দে ফকির করম শাহের পুত্র টিপু শাহের নেতৃত্বে ময়মনসিংহ জেলার শেরপুর পরগনায় গারো উপজাতির লোকেরা যে বিদ্রোহ শুরু করেছিল তা পাগলাপন্থী বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

26. ভিল বিদ্রোহ কি?

1819 খ্রিস্টাব্দে ত্রিম্বকজির প্রেরণায় ও শিবুরামের নেতৃত্বে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পাদদেশে খান্দেশ অঞ্চলের শান্তিপ্রিয় আদিবাসী বা উপজাতি ভিলরা যে আন্দোলন গড়ে তোলে তা ভিল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। সরকার অত্যন্ত নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করেছিলেন।

27. রংপুর বিদ্রোহ কি?

1783 খ্রিস্টাব্দে পূর্ণিয়ার অত্যাচারী ইজারাদার দেবীসিংহের বিরুদ্ধে রংপুর তথা সমগ্র উত্তরবঙ্গের কৃষকরা নুরুলউদ্দিনের নেতৃত্বে যে বদ্রোহ শুরু করে তা রংপুর বিদ্রোহ নামে পরিচিত।মোগলহাট ও পাটগ্রামের যুদ্ধে বিদ্রোহিরা পরাস্ত হলে এই বিদ্রোহের অবসান ঘটে।

28. দুদু মিঞা স্মরণীয় কেন?

1837 খ্রিস্টাব্দে ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তক হাজি শরিয়তউল্লাহ-এর মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র মহম্মাদ মহসিন বা দুদুমিঞা  আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহন করেন ।তিনি ছিলেন দক্ষ সংগঠক ও রাজনৈতিক চেতনা সম্পন্ন ব্যাক্তিত্ব ও এই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ।

তিনি জমিদারদের পূজা-পার্বণ ইত্যাদিতে কর না দেওয়ার পরামর্শ দেন।তার সুযোগ্য নেতৃত্বে ফরাজি আন্দোলন ধার্মীয়-সামাজিক আন্দোলন থেকে সামাজিক –অর্থনোইতিক-রাজনোইতিক আন্দোলনে পরিনত হয়।এই জন্য দুদুমিঞা স্বরণীয়।।।

২9.মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্য কী ছিল?

Ans: a.মুন্ডাদের চিরাচরিত আইন, শাসন ও বিচারব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে ব্রিটিশ সরকার যে নতুন ব্যবস্থা চালু করেছিল,তা বাতিল করে পুনরায় স্বাধীন মুন্ডারাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।


b. “দিকু” অর্থাৎ বহিরাগত জমিদার, মহাজন, ঠিকাদার ও ব্যাবসায়ীদের মুন্ডা অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করা।


30.পাগলপন্থী কাদের বলা হয়?

Ans: ঔপনিবেশিক শাসনকালে অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার সুসঙ্গপুর – শেরপুর অঞ্চলে গারো ও হাজং উপজাতির লোকেরা বসবাস করতেন। করম শাহ(চাঁদ গাজি) নামে জনৈক ফকির এই উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে এক নতুন ধর্মমত(বাউল ধর্ম )প্রচার করেন। এই ধর্মের অনুগামীরা পাগলপন্থী নামে পরিচিত।


31.কোল বিদ্রোহের দুটি কারণ লেখো।

Ans: a. রাজস্ব বৃদ্ধি :: ইংরেজরা কোল অধ্যুষিত অঞ্চলে বহিরাগত বিভিন্ন জমিদারদের ইজারা দেয়। জমিদাররা কোলদের ওপর রাজস্বের পরিমান বহুগুণ বৃদ্ধি করে।

b.অত্যাচার : কর আদায়ের জন্য বহিরাগতরা কোলদের নানাভাবে নিপীড়ন করতো।পুরুষদের বন্দি করে রাখা হত এবং বেগার খাটানো হত।


32.নীল কমিশন কী উদ্দেশ্যে এবং কতজন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়?

Ans: ••নীলচাষিদের অভিযোগ ও নীলচাষ সম্বন্ধে অনুসন্ধানের জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৬০ সালের ৩১ মার্চ নীল কমিশন গঠন করে।

•• পাঁচজন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। (সরকার পক্ষের সীটন কার ও আর টেম্পল, পাদরিদের পক্ষে রেভারেন্ড সেল, নীলকর সমিতির পক্ষ থেকে ফারগুসন এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে চন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায়)।


33.”তারিকা-ই-মহম্মদীয়া” কী?

Ans: “তারিকা-ই-মহম্মদীয়া” কথার অর্থ হল মহম্মদ প্রদর্শিত পথ।ইসলাম ধর্মের মধ্যে যে অ-ইসলামীয় আদর্শ প্রবেশ করেছে তা দূর করে ইসলামের সংস্কার করা ও যথার্থ কোরাণ নির্দেশিত পথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে অষ্টাদশ শতকে আরবে আব্দুল ওয়াহাব নামে এক ব্যক্তি ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন।এই আন্দোলনেরই প্রকৃত নাম “তারিকা-ই-মহম্মদীয়া”।


34.ওয়াহাবি আন্দোলনের ব্যর্থতার দুটি কারণ লেখো

Ans: a.সুপরিকল্পনার অভাব ::বিদ্রোহ পরিচালনা করার জন্য যে সুপরিকল্পনা দরকার তা বিদ্রোহীদের মধ্যে ছিল না।

b. আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাব :: আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীরা পেরে উঠতে পারেনি। কারণ, বিদ্রোহীদের তেমন আধুনিক অস্ত্র ছিল না।

.35.”বেএলাকা চাষ” বলতে কী বোঝো?

Ans: নীলকররা চাষিকে আগাম টাকা দাদন দিয়ে চাষির জমিতে নীলচাষ করার জন্য যখন চুক্তি হত তখন তাকে বলা হত ‘রায়তি’ বা ‘দাদনী’ বা ‘বেএলাকা চাষ’। নীলকররা বেশি লাভের আশায় এই চাষে উৎসাহী ছিল।


                    ### প্রশ্নমান: ৪  ######

1. চুয়াড় বিদ্রোহ সম্পর্কে টীকা লেখ।

ভূমিকাঃ- ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে মেদিনীপুরে উত্তর-পশ্চিম দিক ‘জঙ্গলমহল’ নামে পরিচিত ছিল। এখানে বসবাসকারী অধিবাসিদের চূয়াড় বলা হত। বাকুড়া, পুরুলিয়া ও ধলভূম ছিল জঙ্গলমহলে অন্তর্গত। 1768 -1769 এবং 1798 1799 সালে চুয়াড়রা যে বিদ্রোহ করেছিল তা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

       চুয়াড় বিদ্রোহের কারনঃ- চুয়াড় বিদ্রোহের কারণগুলি হল-

A. উচ্চহারে রাজস্ব আদায়ঃ-চুয়াড়রা কৃষিকাজ ও পশু পালন করলেও তারা পাইকদের অধীনে আধাসামরিক কাজ করত ও পাইকান জমি পেত। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে কোম্পানি পাইকান জমির ওপর উচ্চহারে রাজস্ব ধার্য করে ফলে অত্যধিক রাজস্বের চাপ ও রাজস্ব আদায় কারীদের সীমাহিন অত্যাচার তাদের ক্ষিপ্ত ক্রে তোলে।

B. জীবিকা সমস্যাঃ-চুয়াড়দের প্রধান জীবিকা ছিল পাইক দের অধীনে থেকে পাইকান জমিতে কৃষি কাজ করা বেতনের পরিবর্তে তারা নিষ্কর জমি ভোগ করত। সরকারি পাইকান জমি কেড়ে নিলে তাদের জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে পড়ে ও তারা বিদ্রোহের দিকে এগিয়ে যায়।

উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে 1768 খ্রিস্টাব্দে ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহ প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে। পরে আবার 1798-1799 খ্রিস্টাব্দে দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে চুয়াড় বিদ্রোহ ঘটে।

    চুয়াড় বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্যঃ-

A. সশস্ত্র বিদ্রোহঃ-এই বিদ্রোহ ছিল একটি সশস্ত্র বিদ্রোহ এই বিদ্রোহ বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার হয় বলা হয় যে কর্নগড়ের রানী শিরোমণি ও নাড়াজালের রাজারা আড়াল থেকে গোলাবারুদ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেন।

B. ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহঃ-চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ বিরোধী অভ্যুত্থান। অন্যান্য বিদ্রোহে কৃষকরা জমিদারদের ওপর ক্ষিপ্ত হয় কিন্তু এই বিদ্রোহ ছিল কৃষক ও জমিদারদের মিলিত ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।

  চুয়াড় বিদ্রোহের গুরুত্বঃ- চুয়াড় বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহের বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল-

A. নিরক্ষর চুয়াড় বিদ্রোহ ভারতের শিক্ষিত সমাজের চোখ খুলে দেয়।

B. এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে জমিদারকে ঐক্যবদ্ধ হয়।

C. এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে জমিদার ও কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়।

D. বিদ্রোহের পর সরকার দুর্গম বনাঞ্চল নিয়ে জঙ্গলমহল নামে একটি জেলা গঠন করে

উপসংহারঃ-চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে এর স্বতন্ত্র চরিত্র পাওয়া যায়। চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল ঔপনিবেশিক আইনের বিরুদ্ধে তাদের অধিকার রক্ষার লড়াই। আদিবাসীরা এই বিদ্রোহে অংশ নিলেও নরহরি কবিরাজ এর মতে কৃষকরাই ছিল এর প্রধান স্তম্ভ। সেই কারণে ইতিহাসে এই বিদ্রোহটি গুরুত্বপূর্ণ


## 2.বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের পরিচয় দাও

অথবা বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের তিতুমীরের ভূমিকা আলোচনা করো।

অথবা বারাসাত আন্দোলনের উপর একটি টীকা লেখ

ভূমিকাঃ-  ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন দিল্লির বিখ্যাত মুসলিম সন্ত শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তার পুত্র আজিজ। তবে ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রায়বেরিলির অধিবাসী সৈয়দ আহমেদ।

ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য :- ‘ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত নাম হল ‘তারিকা-ই-মহম্মদীয়া’ অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মহম্মদ প্রদর্শিত পথ। ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামধর্মের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কার দূর করে মহম্মদের নির্দেশ অনুসরণ করে ইসলামধর্মের সংস্কার করা। ওয়াহাবি আন্দোলনকারীরা বিধর্মী ইংরেজ-শাসিত ভারতকে ‘দার-উল-হারব’ (শত্রুর দেশ) বলে অভিহিত করত। তাই তারা ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষ থেকে বিধর্মী ইংরেজদের বিতাড়িত করার জন্য আন্দোলন করেছিল।

তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন:- বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন মির নিশার আলি, যিনি তিতুমির নামে অধিক পরিচিত। তিতুমির 39 বছর বয়সে মক্কায় হজ করতে গিয়ে সৈয়দ আহমদের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং দেশে ফিরে ইসলামধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই আন্দোলন কৃষক আন্দোলন’ -এ পরিণত হয়েছিল। বারাসত অঞলে তিতুমিরের এই আন্দোলন বারাসত বিদ্রোহ’ নামেও পরিচিত।

তিতুমিরের আন্দোলনের মূল কথা ছিল—

                   I.  একমাত্র আল্লাহকে মান্য করতে হবে।

                  II.  মুসলমানদের ইসলামধর্মবহির্ভূত সংস্কার পরিত্যাগ করতে হবে।

                 III.  অনুগামীদের দাড়ি রাখতে হবে।

                 IV.  অত্যাচারী জমিদারদের রাজস্ব দাবির বিরোধিতা করতে হবে।

তিতুমিরের বিরুদ্ধে জমিদারদের প্রতিক্রিয়া:-তিতুমিরের প্রভাবে 24 পরগনা, নদিয়া, মালদহ, রাজশাহি, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকরা ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করলে জমিদার, নীলকর সাহেব ও মুসলমান মোল্লারা তিতুমিরের বিরোধিতা শুরু করে। পুড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব  রায় তিতুমিরের অনুগামীদের দমন করার জন্য দাড়ির উপর 2.5 টাকা কর ধার্য করেছিলেন। তিতুমির বারাসতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজেকে ‘স্বাধীন বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন ও মইনউদ্দিন নামে এক অনুগামীকে প্রধানমন্ত্রী এবং ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে প্রধান  সেনাপতি নিযুক্ত করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার পরিকল্পনা করেন। তিনি নারকেলবেড়িয়ার সদর দপ্তরে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে ওই অঞ্চলের জমিদারদের কাছে রাজস্ব দাবি করেন।

বারাসত বিদ্রোহের অবসান:- তিতুমিরের বিরুদ্ধে স্থানীয় জমিদার ও নীলকর সাহেবরা গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্কের শরণাপন্ন হলে 1831 খ্রিস্টাব্দে লর্ড বেন্টিং তার বিরুদ্ধে  এক অভিযান প্রেরন করেন এবং কামানের আঘাতে বাঁশেরকেল্লা ধ্বংস হয়। তিতুমীর ও তার কয়েকজন অনুগামী বীরের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেন বন্দি সৈন্যদের ফাঁসি হয় এবং অনেকে দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড ভোগ করেন।

গুরুত্ব:- ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ওয়াহাবি আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। তিতুমিরের নেতৃত্বে পরিচালিত ওয়াহাবি আন্দোলন ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও এটি কৃষক বিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহণ করেছিল। অত্যাচারী জমিদার ও নীলকর সাহেবদের হাতে নির্যাতিত মানুষদের সংগঠিত করে তিতুমির বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। তাই এই আন্দোলনের গুরুত্ব কে অস্বীকার করা যায় না।

## 3.মুন্ডা বিদ্রোহের (1899-1900 খ্রিস্টাব্দ) কারণগুলি আলোচনা কর।

ভূমিকা: বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডা উপজাতির মানুষদের পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ ও অসন্তোষের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি হল মুন্ডা বিদ্রোহ (1899-1900 খ্রিস্টাব্দ)

মুন্ডা বিদ্রোহের কারণ:- সহজ, সরল কৃষিজীবী মুন্ডাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিদ্রোহের কারণগুলি হল-

1. জমির ওপর অধিকার হারানো:- ইংরেজ শাসন প্রবর্তিত হলে বাইরের থেকে লোভী মানুষেরা এসে নিরীহ কৃষিজীবী মুন্ডাদের জমি জায়গা কুক্ষিগত করে নিতে থাকে এবং মুন্ডাদের বিতাড়িত করে সেই জমিগুলি দখল করে নিলে মুন্ডারা ক্ষুব্ধ হয়।

2. খুঁৎকাঠি প্রথার অবসান :- ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর মুন্ডাদের খুঁকাঠি প্রথা বা জমির যৌথ মালিকানার অবসান ঘটিয়ে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলে মুন্ডারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

3. নতুন আইনবিধি:- অতি ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর মুন্ডাদের চিরাচরিত ঐতিহ্যবাহী মুন্ডারি, আইন, বিচার ও সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে নতুন ধরনের আইন প্রবর্তন করলে মুন্ডারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

4. বেগার শ্রমঃ- নিরীহ মুন্ডাদের দিয়ে সরকারি কর্মচারী, জমিদার, মহাজনরা দিনের পর দিন বিনা মজুরিতে বেট বেগারি প্রথায় কাজ করতে বাধ্য করলে অবশেষে মুন্ডারা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়।

5. বিরসা মুন্ডার ভূমিকা:- ধর্মপ্রচারক হিসেবে জীবন শুরু করলেও বিরসা মুন্ডার সংস্কারমূলক বিবিধ ব্যবস্থা, হীনম্মন্যতাকে দূর করে মুন্ডাদের মাথা উঁচু করে বাঁচার শিক্ষা মুন্ডা বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।

উপসংহার :- উপরোক্ত কারণগুলি ছাড়াও মহাজন, জমিদার, জায়গিরদার, ঠিকাদার, চা ব্যবসায়ীদের মিথ্যা প্রলোভন ও শোষন এবং খ্রীষ্টান মিশনারিদের ধর্মপ্রচার ছিল এই বিদ্রোহের অন্যতম কারন। 

4.সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষেপে যা জান লেখো।

ভুমিকাঃ- সাঁওতালরা ছিল বীরভূম, মানভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদের প্রাচীন অধীবাসি। এরা ছিল কঠোর পরিশ্রমী ও শান্তিপ্রিয়, বিনিময় প্রথা ভিত্তিক কৃষিজিবী জনগোষ্ঠী। ভাগলপুরে রাজমহল পাহাড়ের প্রান্তদেশে বনভূমি পরিষ্কার করে বসবাস করত। এটি ‘দামিন-ই-কোহ’ নামে পরিচিত যার অর্থ হল ‘পাহাড়ের প্রান্তদেশ’। ইংরেজদের চাপে তারা 1811-1881 এর মধ্যে সাতবার বিদ্রোহ করে, এর মধ্যে 1855-56 এর বিদ্রোহ ছিল সবথেকে ব্যাপক ,ভয়ঙ্কর ও গুরুতর।

বিদ্রোহের কারণঃ- নতুন দামিন-ই-কোহ অঞ্চলেও সাঁওতালরা  জমিদার ও কর্মচারীদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি তাই তারা শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ ঘোষন করেন। নিম্নে বিদ্রোহের কারনগুলি উল্লেখ করা হল—

1.   খাজনা বৃদ্ধিঃ- বাংলা,বিহার, উড়িষ্যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হলে তাদের তৈরী করা পাথুরে জমি থেকে আবাদি জমিতএ নতুন ভুমিব্যাবস্থায় খাজনা ধার্য করা হয়। বিনা খাজনায় অভ্যস্ত সাঁওতালদের খাজন ক্রমে বৃদ্ধি পেলে তাদের মধ্যে তীব্র বিক্ষভের সৃষ্টি হয়।

2.   মহাজনদের শোষণঃ- নতুন ভুমিরাজস্বে নগদ অর্থে খাজনা দিতে হত। সাঁওতালরা নগদ অর্থের জন্য মহাজনদের কাছে ঋণ নিতে বাধ্য হত যার সুদ প্রায় 50%-500% ছিল। একবার ঋণ নিলে তারা বেরিয়ে আসতে পারতনা তাই মহাজনরা তাদের উপর নির্মম অত্যাচার চালাত। সর্বস্ব হারানোর পরেও নিজেকে দাসে পরিনত হতে হত।

3.   বহিরাগত ব্যাবসায়ীদের কারচুপিঃ- বিদেশি ব্যাবসায়ীরা দোকান খুললে ফসলের বিনিময়ে চড়া দামে দ্রব্য কিনতে গিয়ে সর্বশান্ত হত। ব্যাবসায়ীরা ভুয়া বাটখারায় (কেনারাম,বেচারাম) কেনা বেচা করে ঠকাতো। তাদের এই কারচুপি জানতে পারলে সাঁওতালরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

বিদ্রোহের সূচনাঃ- এইসব অত্যাচারের প্রতিবাদে তারা স্থানীয় কতৃপক্ষের কাছে আবেদনে সমস্যা মিটবেনা বুঝতে পারে তাই তারা 1855 সালে 30 জুন ভাগনাডিহির মাঠে সিধু ও কানু নামে দুই ভাই-এর নেতৃত্বে 10 হাজার সাঁওতাল ‘স্বাধীন সাঁওতার রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করে।

বিদ্রোহের দমনঃ- আধুনিক অস্ত্রশাস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে লাঠি, ট্যাঙ্গি, বল্লম, তীরধনুক নিয়ে সাঁওতালরা তাদের কাছে পরাজিত হয়। 23 হাজার বিদ্রোহীকে হত্যা করে সিধু কানু সহ অন্যান্য নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। এইভাবে 1856 সালে ইংরেজরা নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করেছিল।

ফলাফলঃ- এই বিদ্রোহের ফলে –

             i.   সাঁওতাল অধুষ্যিত এলাকা নিয়ে ‘সাঁওতাল পরগনা’ জেলা গঠন করা হয়।

             ii.   সাঁওতালদের পৃথক উপজাতি বলে ঘোষণা করা হয় এবং বলা হয় ব্রিটিশ আইন এখানে কার্যকর হবেনা

            iii.   খ্রীষ্টান মিশনারি ছাড়া সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়

উপসংহারঃ- এই বিদ্রোহ ছিল একটি তীব্র ব্রিটিশ বিরুদ্ধ প্রতিবাদ নরহরি কবিরাজের মতে এই বিদ্রোহ ছিল সকল সম্প্রদায়ের দরদ্র মানুষদের মুক্তি যুদ্ধ। কালীকঙ্কর বলেন- ‘’বাংলা, বিহারের ইতিহাসে এই বিদ্রোহ নবযুগের সূচনা করে’’। সুপ্রকাশ রায় বলেন- ‘’সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল ভারতের প্রথম মুক্তি সংগ্রাম’’

5. ফরাজি আন্দোলনের উপর একটি টীকা রচনা করো। 

ভূমিকাঃ- একজন বিখ্যাত ধর্মসংস্কারক এবং ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে সংঘটিত ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহ 1781 খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুর গ্রামে এক কৃষকপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা, মক্কা ও কায়রোয় দীর্ঘকাল কোরান ও ইসলামী ধর্মতত্ত্বের পাঠগ্রহণ করেন এবং ধর্ম সংস্কারক-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

আদর্শঃ- আরবি ভাষায় ‘ফরাজি’ কথার অর্থ হল ইসলাম-নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য। শরিয়উল্লাহ ঘোষণা করেন যে, ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরে ইসলাম-বিরোধী নানা কুসংস্কার ও দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কোরানের নিদের্শ যথার্থভাবে পালন করে তিনি ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধনের কথা বলেন। ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও অচিরেই এই আন্দোলন রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষকে তিনি ‘দার-উল-হারব’ বা শত্রুর দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন যে, এই দেশ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের বাসের যোগ্য নয়। তিনি জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন এবং অচিরেই বরিশাল, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও ফরিদপুরের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মুসলিম চাষি, কারিগর ও বেকার তাতি তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। এইভাবে বাংলার কৃষকদের মধ্যে এক জাগরণের সৃষ্টি হয় এবং তারা জমিদারের অন্যায় অত্যাচার ও জুলুমের প্রতিবাদ জানাতে সাহসি হয়।

দুদু মিঞার ভূমিকাঃ- 1837 খ্রিস্টাব্দে শরিয়ত উল্লাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দুদু মিঞা (মহম্মদ মহসীন) 1860 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি বাহাদুরপুরে প্রধান কার্যালয় স্থাপন করে, লাঠিয়াল ও গুপ্তচর বাহিনী গঠন করেন এবং  জমিদার নীলকরদের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করে ফরাজি আন্দোলনকে ধর্মীয় আন্দোলন থেকে আর্থ সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে উন্নীত করেন। আতঙ্কিত জমিদার, মহাজন, নীলকরদের চাপে 1838 খ্রিস্টাব্দে,1841 খ্রিস্টাব্দে এবং 1857 খ্রিস্টাব্দে দুদু মিঞাকে গ্রেপ্তার করা হলেও প্রমাণ না পাওয়ায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। 1860 খ্রিস্টাব্দে দুদু মিঞার মৃত্যুর পর তার পুত্র নোয়া মিঞা এই আন্দোলনে ধর্মীয় আদর্শকে গুরুত্ব প্রদান করলে এই আন্দোলনের গুরুত্ব কমে যায়।

প্রকৃতিঃ- ঢাকা, বরিশাল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা প্রভৃতি জেলায় এই আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। ফরাজি আন্দোলন ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে। শুরু হলেও ক্রমশ তা জমিদার-বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। অধিকাংশ জমিদাররাই হিন্দু হলেও ফরাজি আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক আন্দোলন ছিল না, কারণ এই আন্দোলনে মুসলমান কৃষকদের পাশাপাশি বহু হিন্দু কৃষকও শামিল হয়েছিল।

ব্যর্থতার কারণঃ-  দুদু মিঞার মৃত্যুর পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, ধর্মীয় সংকীর্ণতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। এ ছাড়া সাধারণ লোককে জোর করে দলভুক্ত করা, অর্থ আদায়, সরকারি দমননীতি প্রভৃতি কারণে ফরাজি আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়।

 গুরুত্বঃ- ফরাজি আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও ব্রিটিশ বিরোধী কৃষক আন্দোলন হিসেবে এই আন্দোলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ড. অভিজিৎ দত্ত বলেছেন, ফরাজিরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উচ্ছেদ করতে না পারলেও বাংলা থেকে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ কামনা করেছিল।

6. ভারতে ফরাজি ও ওয়াহাবি আন্দোলনের তুলনামূলক আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ-ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় হিন্দু জমিদার ও ব্রিটিশ শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে নিম্নবর্গীয় মুসলিম সমাজ একাধিক ধর্মীয় আন্দোলনে লিপ্ত হয়েছিল। এই ধর্মীয় আন্দোলনগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল ফরাজি এবং ওয়াহাবি বা তরিকা-ই-মহম্মদীয়া আন্দোলন।আপাতদৃষ্টিতে দুটি আন্দোলনই হিন্দু জমিদার ও শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত ধর্মীয় আন্দোলনরূপে প্রতিভাত হলেও বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে এদের প্রকৃতি ছিল পরস্পরের থেকে ভিন্ন।

ফরাজি ও ওয়াহাবি আন্দোলনের পারম্পরিক সাদৃশ্য হল-

1.   সূচনালগ্নে উভয় আন্দোলনের ভিত্তিই ছিল কোরান।

2.   ওয়াহাবি আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ইসলামের পুনরুজ্জীবন। উভয় আন্দোলনই ধর্মযুদ্ধের দ্বারা এই দেশকে ইসলামের পবিত্র ভূমি বা দার-উল-ইসলাম-এ পরিণত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল।

3.   উভয় আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল হিন্দু জমিদার এবং ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী।

4.   উভয় আন্দোলনেই সাধারণ মানুষ, কৃষক ও শ্রমজীবীদের সংঘবদ্ধ করার জন্য ইসলামকে ব্যবহার করা হয়েছিল।

ফরাজি ও ওয়াহাবি আন্দোলনের পারস্পরিক বৈসাদৃশ্য-

ফরাজি ও ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল মোটামুটি সমসাময়িক, উভয় আন্দোলনেরই সময়কাল ছিল ঊনবিংশ শতাব্দী। এ ছাড়া হিন্দু জমিদার ও শাসক বিরোধী ধর্মীয় আন্দোলন রূপে পরিচালিত হওয়ার কারণে উভয় আন্দোলনের মধ্যেই কিছু সাধারণ সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এদের পারস্পরিক বৈসাদৃশ্যগুলি বিশেষভাবে লক্ষণীয়

1.   বিস্তৃতির দিক থেকে ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ফরাজি আন্দোলনের তুলনায় ব্যাপকতর। যদিও বাংলায় এর কেন্দ্রস্থল ছিল বারাসাত ও তার সংলগ্ন অঞল কিন্তু এর উৎপত্তি ঘটেছিল আরব দেশে এবং বাংলার বাইরেও উত্তর ভারতে এই আন্দোলনের অস্তিত্ব লক্ষ করা গিয়েছিল। অপরদিকে ফরাজি আন্দোলন ছিল মূলত পূর্ববঙ্গ বা বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

2.   উভয় আন্দোলনের লক্ষ্য ইসলামের শুদ্ধিকরণ হলেও ফরাজি নেতা হাজি শরিয়উল্লাহ কোরানে নেই এমন যাবতীয় উৎসব-অনুষ্ঠান বর্জন করার নির্দেশ। দিয়েছিলেন, কিন্তু ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তেমন কোনো নির্দেশ দেননি।

3.   ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে পরিচালিত এবং এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ইংরেজ রাজত্বের বিকল্প একটি মুসলিম রাজ্যগঠন। অপরপক্ষে ফরাজি আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল কৃষকদের স্বার্থরক্ষা, ফলে এই আন্দোলন পরিণত হয়েছিল একটি কৃষক বিদ্রোহে।

4.   ফরাজি আন্দোলনের কার্যকলাপের মধ্যে সাম্যবাদ ও প্রজাতন্ত্রের ধারণার অস্তিত্ব ছিল যা ওয়াহাবি আন্দোলনে দেখা যায়নি।

5.   1831 খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কর্তৃক তিতুমিরের বারাসাত বিদ্রোহ দমনের মাধ্যমে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের অবসান ঘটেছিল। অপরপক্ষে, দুদু মিঞার উত্তরাধিকারীগণ ধর্মসংস্কারে মনোনিবেশ করায় ফরাজি। | আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।

উপসংহারঃ-সুতরাং, বিস্তৃতি ও লক্ষ্যের দিক থেকে ফরাজি আন্দোলনের ব্যাপকতা ছিল ওয়াহাবি আন্দোলনের তুলনায় কম, কিন্তু ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ফরাজি আন্দোলনের তুলনায় অধিক মাত্রায় সাম্প্রদায়িক। কিন্তু উভয় আন্দোলনই বাংলার নিম্নবর্গের মানুষের মর্যাদা ও স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যদিও তা একইসঙ্গে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশয় দিয়েছিল।

7. টীকা লেখো: সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ

ভূমিকাঃ- ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাংলায় সর্বপ্রথম সংঘটিত প্রতিরোধ আন্দোলন ছিল সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ। কৃষিজীবী হিন্দু সন্ন্যাসী ও মুসলমান ফকিরদের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন(1763-1800 খ্রীঃ) ধরে এ বিদ্রোহ চলেছিল।

বিদ্রোহের কারনঃ- এই বিদ্রোহের কারণগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে,

1. রাজস্ব বৃদ্ধিঃ- ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অত্যাধিক রাজস্ব বৃদ্ধি কৃষিজীবী সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ক্ষুব্ধ করে তোলে।

2. তীর্থকরঃ- বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য সরকার থেকে সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ওপর তীর্থ কর আদায় করা শুরু হলে সন্ন্যাসী ও ফকিররা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

3. কোম্পানির কর্মচারীদের জুলুমঃ- ফকির সন্ন্যাসীদের মধ্যে অনেকে রেশম ব্যবস্থা সঙ্গে যুক্ত ছিল। কোম্পানীর কর্মচারীরা তাদের এই ব্যবস্থায় নানাভাবে জুলুম ও বাধা প্রদান করত।

4. মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ অত্যাচারঃ- কোম্পানির কর্মচারিরা ছাড়াও ইজারাদার, পত্তনিদার প্রভূতি মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ ও অত্যাচার সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।

5. নিষেধাজ্ঞাঃ- ফকিরদের নিয়ন্ত্রনের উদ্দ্যেশে কোম্পানী তাদের দরগায় যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে ফকিররা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

6. মন্বন্তরঃ- ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় (1770 খ্রিস্টাব্দে) বহু মানুষের মৃত্যু হলেও সরকার দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে কৃষকদের উপর রাজস্বের চাপ সৃষ্টি করলে সন্ন্যাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

বিদ্রোহের প্রকৃতি: ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের সূচনা হয় । ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে বাংলা ও বিহারের দরিদ্র কৃষকেরা অন্ন ও বস্ত্রের জন্য সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহে রোগ দেন। বিদ্রোহের আগুন ক্রমশঃ রাজশাহি, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, কোচবিহার, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে । উত্তরবঙ্গের 'মাদারি' সম্প্রদায়ের ফকির এবং পূর্ববঙ্গ ও 'ময়মনসিংহের' 'গিরি' ও দাশনামী, মারাঠা সম্প্রদায়ভুক্ত 'গোঁসাই' এবং শৈব সম্প্রদায়ভুক্ত নাগা সন্ন্যাসীরা, ভোজপুরি রাও প্রমূখ এই বিদ্রোহে যোগ দেয় । পরে ক্ষমতাচ্যুত জমিদার, ছাঁটাই হওয়া সৈনিক ও বিতাড়িত কৃষকেরা এ বিদ্রোহে যোগ দেয় । সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'আনন্দমঠ' উপন্যাসে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেছেন । এই বিদ্রোহের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের মধ্য ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, কৃপানাথ, মুশা শাহ, মজনু শাহ, পরাগল শাহ, চিরাগ আলি শাহ, অনুপ নারায়ণ, নুরুল মহম্মদ, পীতাম্বর শ্রীনিবাস প্রমুখ অন্যতম ।

ব্যর্থতার কারণ:

১) সুযোগ্য নেতৃত্ব ও নেতাদের অভিজ্ঞতার অভাব এবং সাংগঠনিক দুর্বলতা,

২) সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা,

৩) আদর্শহীনতা এবং সাম্প্রদায়িক অনৈক্য,  

৪) উপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্রের অভাব প্রভৃতি কারণে এই চার দশক ধরে চলতে থাকা সন্ন্যাসী বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় ।

মূল্যায়নঃ- ওয়ারেন হেস্টিংস এই বিদ্রোহকে ‘পেশাদারী ডাকাতদের উপদ্রব’ বলে অভিহিত করলেও উইলিয়াম হান্টার সর্বপ্রথম সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে ‘কৃষক বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেছেন।

8. কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেছিল ?

>>উত্তর:

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ভারতে পরপর তিনটি অরণ্য আইন প্রণয়ন করে, একটি ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে একটি ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে এবং আরেকটি ১৯২৭ খ্রি:। এই সবকটি আইনেরই মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক স্বার্থ রক্ষা করা এবং ভারতের বনভূমির ওপর আধিপত্য স্থাপন করা। 


[১] কাঠ সংগ্রহঃ

উনিশ শতকের শেষদিকে ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর সম্প্রসারণের জন্য প্রচুর কাঠের প্রয়োয়জন দেখা যায়; পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য রেলপথ নির্মাণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তার জন্য প্রচুর কাঠের তক্তার প্রয়োজন পড়ে। এইসব প্রয়োজনের নিরিখে অরণ্য সম্পদের ওপর অধিকার কায়েমের জন্য ঔপনিবেশিক সরকার ‘অরণ্য আইন’ পাশ করেছিল।

[২] বনাঞ্চল পরিষ্কারঃ

অরণ্য আইন পাশের পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল, ভারতের সুবিশাল বনভূমিকে পরিষ্কার করে কৃষিযোগ্য করে তোলা। এছাড়াও বনাঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ঝুম চাষের পরিবর্তে স্থায়ী কৃষিকাজে অভ্যস্থ করে তোলার তাগিদ ছিল।

[৩] রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধিঃ    

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল নতুন কৃষিজমির ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে রাজস্ব বৃদ্ধি করা ও ভারতের সম্পদ আত্মস্থ করা।

[৪] সরকারের আয় ও ব্যবসাবাণিজ্যের বৃদ্ধি:

রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি বনজ সম্পদকে বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যয় করে আয় ও মুনাফা বৃদ্ধি করা ছিল ঔপনিবেশিক সরকারের উদ্দেশ্য।

[৫] বন সংরক্ষণঃ

অরণ্য আইন জারি করার পেছনে ঔপনিবেশিক শক্তির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যাই থাক না কেন, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই সরকার ভারতের বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত অরণ্য, সুরক্ষিত অরণ্য এবং গ্রামীণ অরণ্য (অশ্রেণিভুক্ত) – এই তিনটি ভাগে ভাগ করে বন সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে ঔপনিবেশিক সরকার স্বার্থ ও মুনাফা বজায় রাখতে গিয়ে অরণ্য আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বাধিকার, জীবন ও জীবিকার মূলে কুঠারাঘাত করেছিল যার ফলে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন কৃষক – উপজাতি বিদ্রোহ।

উপসংহার:

উনিশ শতকের শেষদিকের সামাজিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে অরণ্য আইন প্রণয়ন ছিল একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই আইনের প্রেক্ষিতে বাংলার আদিবাসী কৃষক সম্প্রদায়ের মানুষ সর্বপ্রথম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।

9.  নীল বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের মনোভাব কীরূপ ছিল?

>>> উত্তর:     নীলচাষীদের বিরুদ্ধে নীলকর সাহেবদের চরম অত্যাচার সীমা ছাড়ালে তা ১৮৫৯-৬০ খ্রি নীল বিদ্রোহে রূপ নেয়। ধীরে ধীরে যখন এই বিদ্রোহের আগুন তীব্র হয়ে উঠেছিল তখন বিভিন্ন বাঙালি শিক্ষিত সমাজ তাদের সমর্থন জুগিয়েছিল। 

    বাংলার নীল চাষীদের উপর নীলকর সাহেবরা যে অত্যাচার করত তা সর্বপ্রথম শিক্ষিত সমাজের সমাচার চন্দ্রিকা ও সমাচার দর্পণ পত্রিকাটি দুটি তুলে ধরে। পরবর্তীকালে অক্ষয় কুমার দত্তের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সর্ব প্রথম নীল কর দের অত্যাচার নিয়ে বিশদ আলোচনা করে।

     বাংলার বিশিষ্ট শিক্ষিত সম্প্রদায় যেমন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, মোহন ঘোষ, শিশির কুমার ঘোষ, কিশোরী চাঁদ মিত্র, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ প্রমূখ ব্যক্তিবর্গ নীলচাষীদের একতাবদ্ধ করে সংগ্রামকে আরো শক্তিশালী করতে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তৎকালীন উল্লেখযোগ্য শিক্ষিত হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নীল চাষীদের জন্য তার বাড়িকে অতিথিশালায় পরিণত করেছিল। এমনকি তাঁর বাড়িতে নীল বিদ্রোহের বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হতো ।

    সর্বোপরি দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক প্রকাশিত হওয়ার পর বাঙালির শিক্ষিত সমাজ নীলচাষীদের পক্ষ নিয়ে  নীল বিদ্রোহ কে আরো জোরদার করে তুলেছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ করেন ও খ্রিস্টান মিশনারি রেভারেন্ড জেমস লঙ নিজ নামে প্রকাশ করেছিলেন । স্বার্থবিরোধী হওয়ায় লং সাহেবের নামে নীলকররা মামলা করে । মামলায় লং সাহেবের এক মাস কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা হয় । জরিমানার টাকা দেন কালিপ্রসন্ন সিংহ । নীলদর্পণ নাটক ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় এই নাটক অনূদিত হয় । 'নীলদর্পণ' নাটক সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও অত্যাচার সম্পর্কে শিক্ষিত বাঙালি সমাজকে সচেতন ও প্রতিবাদী করে তোলে । এই নাটক বাঙালির মনে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয় ।

প্রখ্যাত আইনজীবী শম্ভুনাথ পন্ডিত, প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও তিনু চক্রবর্তীর মতো কিছু আইনজীবী ছাড়া অধিকাংশ আইনজীবী নিজেদের স্বার্থে এবং যতটা সম্ভব গা বাঁচিয়ে কৃষকদের সাহায্য করেছিলেন ।

    নীল বিদ্রোহের সময়ে বিভিন্ন শিক্ষিত সম্প্রদায় নীল বিদ্রোহ কে আরও চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার জন্য নিজেদেরকে এই বিদ্রোহের সঙ্গে কোন না কোন ভাবে জড়িত করে তুলেছিল। একথা বলা উচিত হবে যে এই সকল শিক্ষিত সম্প্রদায় এর জন্য নীল বিদ্রোহ তা খুব সহজে সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছিল।

10. নীল বিদ্রোহের কারন ও ফলাফল আলোচনা করো ( প্রশ্নমান- ৮)

>> উত্তর: নীল চাষ ছিল ভারতের একটি প্রাচীনতম চাষ। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে ক্ষমতা বিস্তার করতে শুরু করলে ব্রিটিশ বণিকরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে নীল চাষ শুরু করে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নীলকর সাহেবদের সীমাহীন লোভ, শোষণ ও নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে নীল চাষিরা বিষ্ণুচরন বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস এর নেতৃত্বে নীল বিদ্রোহ(1859-60 খ্রিঃ) ঘোষণা করে। নদীয়া জেলার চৌগাছা গ্রামে এই বিদ্রোহ শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে মালদা, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর, পাবনা, যশোহর রাজশাহী ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলে।

নীল বিদ্রোহের কারণঃ বাংলায় নীল বিদ্রোহের কারণগুলি ছিল----

i) দাদন প্রথাঃ নীলকররা চাষীদের নীল চাষের জন্য অগ্রিম টাকা দিত। এই অগ্রিম টাকাকেই দাদন বলা হয়। চাষিরা অসুবিধায় পড়ে দাদন নিত। মাত্র দু টাকার বিনিময় চাষি তার উৎকৃষ্ট একবিঘা জমিতে নীল চাষ করতে বাধ্য হত। একবার কোন চাষী দাদন নিলে সারাজীবনেও তা পরিশোধ হত না। 

ii) নীলকরদের অত্যাচারঃ নীলকররা চাষীদের উপর ব্যাপক অত্যাচার করত। নীলকর সাহেবদের লাঠিয়াল বাহিনী চাষীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত, তাদের স্ত্রী-কন্যাদের অপহরণ ও অসম্মান করত। চাষীদের উপর দৈহিক অত্যাচার চালানো হতো। চাষীদের গবাদি পশু নিয়ে চলে যেত লাঠিয়াল বাহিনী। যত দিন যাচ্ছিল অত্যাচারের মাত্রা বেড়েই চলেছিল।

iii) প্রতারনা ও অলাভজনক চাষঃ নীলকর সাহেবরা কৃষকদের সাথে বিভিন্ন ভাবে প্রতারণা করত। উৎপাদিত নীলের দাম অত্যন্ত কম দেয়া হতো এবং তা খারাপ মানের বলে চাষীকে বাধ্য করা হতো নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে। আবার জমি মাপের সময়ে ব্যাপক কারচুপি করা হতো। প্রায় আড়াই বিঘা জমি কে এক বিঘা বলত। ফলে চাষী নীল চাষ করে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতো। এই নীলচাষ একটি অলাভজনক চাষ এ পরিনত হয়। ফলে চাষীদের আর্থিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে।

iv) পঞ্চম আইনঃ 1830 খ্রিষ্টাব্দে লর্ড বেন্টিং প্রবর্তিত পঞ্চম আইনে বলা হয় দাদন না নিয়ে নীল চাষ করলে তা বেআইনি বলে ঘোষণা করা হবে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করা যাবে না এবং নির্দিষ্ট চাষীকে নিষিদ্ধ চাষের জন্য জেলে ভরা হবে। এর ফলে চাষীরা দাদন নিতে বাধ্য হয় এবং নীলচাষ তাদের কাছে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।

v) অব্যবস্থা ও অবিচারঃ নীল বিদ্রোহের পূর্বে নীরা নীলকররা ব্যাপক অব্যবস্থা তৈরি করেছিল। নীলকরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ চাষীরা প্রশাসনের দ্বারস্থ হলে সুবিচার পেতে না উল্টে তাদের নানাভাবে হেনস্থা করা হতো। এর ফলে চাষিরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল।

vi) বিভিন্ন পত্রিকা ও বিদ্রোহের প্রভাবঃ নীল বিদ্রোহের জন্য অন্যতম ভূমিকা অবলম্বন করেছিল তৎকালীন সময়কার বিভিন্ন পত্রপত্রিকা। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় নিয়মিত নীলচাষীদের উপর হওয়া অত্যাচার ছাপা হতো। দীনবন্ধু মিত্রে র লেখা নীলদর্পণ নাটকে নীলকর সাহেবদের ভয়ঙ্কর অত্যাচার তুলে ধরা হয়। সেই সময় শিক্ষিত সচেতন মানুষদের নীলচাষীদের সমর্থনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

নীল বিদ্রোহের পূর্বে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিদ্রোহ যেমন-সাঁওতাল বিদ্রোহ, মহাবিদ্রোহ থেকে চাষীরা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।

* নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব/ফলাফলঃ নীল বিদ্রোহের ফলাফল হল--

i) নীল কমিশনঃ নীল বিদ্রোহের ফলে 1860 খ্রিষ্টাব্দের 31 ডিসেম্বরে নীল কমিশন গঠন করা হয়। 1868 খিষ্টাব্দে অষ্টম আইন দ্বারা 'নীলচুক্তি আইন' বাতিল করে নীল চাষ কি ইচ্ছাধীন চাষে পরিণত করা হয়। এর ফলে নীলকররা বাংলা ছেড়ে বিহার ও পার্বত্য অঞ্চলে চা চাষের জন্য অর্থ বিনিয়োগ করতে শুরু করে।

ii) জাতীয়তাবোধঃ নীল বিদ্রোহের সাফল্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালীদের মধ্যে জাতীয়তাবোধের জাগরণ ঘটিয়েছিল। শিশির কুমার ঘোষ বলেছিলেন "এই নীল বিদ্রোহ সর্বপ্রথম দেশের লোককে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তার শিক্ষা দেয়।"

iii) মহাজনদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাঃ নীল বিদ্রোহে সাফল্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নীলকরদের পতন এবং মহাজন' শ্রেণীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। পরবর্তীকালে কৃষকদের জমির কর্তৃত্ব লোভী সুদখোর মহাজনকে হাতে চলে যায়।

  পরিশেষে কথা বলা যায় নীল বিদ্রোহ ছিল ভারতবর্ষের প্রথম সফল বিদ্রোহ। নীলচাষীদের আন্দোলন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সম্প্রদায় তথা ভারতবাসী সামনে ব্রিটিশদের অত্যাচার তুলে ধরতে সক্ষম হয় আর চাষীদের এই সংগ্রাম ভারতীয়দের মনে জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটায় যা পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ সুগম করে। 

#11. সাঁওতাল বিদ্রোহের কারন ও ফলাফল গুলি আলোচনা করো।

>> উত্তর:  ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন কালে ভারতে যে সমস্ত কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহ হয়েছিল সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল 1855 56 সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ। কঠোর পরিশ্রমী শান্তিপ্রিয় ও সরল প্রকৃতির কৃষিজীবী আদিবাসী সম্প্রদায়ের সাঁওতালরা ব্রিটিশ শাসন ও ব্রিটিশদের আশ্রয়পুষ্ট জমিদার ও মহাজনদের নির্মম শোষনের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল তখ সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে  পরিচিত। এই বিদ্রোহের পিছনে ছিল একাধিক কারণে সমাবেশ। সেগুলি হল-

১)রাজস্বের চাপ:-বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুর, মানভূম, ছোটনাগপুর ও পালামৌ অঞ্চলের গভীর বনভূমিতে সাঁওতালরা বসবাস করত এবং কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে কৃষি কার্যের দ্বারা জীবিকা নির্ভর করত। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর ওই অঞ্চল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্বের অধীনে আসে। জমিদার ও কোম্পানির কর্মচারীদের অত্যাচারে তারা ওই অঞ্চল ত্যাগ করে রাজমহল পার্বত্য অঞ্চল  ও মুশিদাবাদের একাংশে বনভূমি পরিষ্কার করে বসবাস ও কৃষিকাজ শুরু করে। এই অঞ্চল দামিন-ই-কোহ বা পাহাড়ের  প্রান্তদেশ নামে পরিচিত। কিন্তু কিছুদিন পর সরকার ওই অঞ্চলেও জমিদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে সাঁওতালদের ওপর পুনরায় রাজস্বের চাপ বৃদ্ধি পায়। ফলে সাঁওতালরা ক্ষুব্ধ হয় ও বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়।

২)মহাজনি শোষণ:-নতুন জমিদারি ভুমি বন্দোবস্ত অনুযায়ী সাঁওতালদের নগদ অর্থে খাজনা মিটাতে হতো। রাজস্ব প্রদান ও খাদ্যাভাব মেটাতে তাদের মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হতো। সাঁওতালদের সরলতা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে মহাজনরা তাদের কাছ থেকে যথেচ্ছ হারে সুদ আদায় করত। একবার ঋণ নিলে ঋণের জাল থেকে বেরিয়ে আসা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হতো না। ঋণের দায়ে তাদের চাষের বলদ, জমির ফসল, জমি, পরিবার, এমনকি নিজেকেও হারাতে হত। তাই এই ঋণের  জাল থেকে মুক্তির আশায় সাঁওতালরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

৩)ব্যবসায়ী শোষণ:-বিভিন্ন ব্যবসায়ীরাও  সাওতালদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাদের কাছে বেশি দামি জিনিস বিক্রি করতো এবং কম দামে সাঁওতাল দের কাছ থেকে জমির ফসল কিনত। শুধু তাই নয় তারা কেনারাম ও বেচারাম নামক দু'ধরনের বাটখারা ব্যবহার করে সাঁওতালদের ওজনেও ঠকাতো। এই অন্যায়ের প্রতিকারের আশায় তারা বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়।

৪)নীলকরদের শোষণ:-সাঁওতালদের ক্ষোভের আরেকটি কারণ ছিল নীলকরদের শোষন ও অত্যাচার ।নীলকর সাহেবরা খাদ্যশস্যের পরিবর্তে সাঁওতালদের নীল চাষে বাধ্য করতো এবং নীলচাষ করতে অস্বীকার করলে সমগ্র সাঁওতাল পরিবারের উপর তারা শারীরিক নির্যাতন চালাতো। এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সাঁওতালরা বিদ্রোহে সামিল হয়েছিল।

৫)সরকারি কর্মচারীদের অত্যাচার:-সরকারি কর্মচারী ও বিচার বিভাগ অন্যায় ভাবে জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। উপজাতি ভুক্ত সাঁওতালদের সভ্যতার লজ্জা মনে করে সরকারি কর্মচারীরা তাদের উপর অত্যাচার চালাত।এঅবস্থায় তারা কোম্পানির সরকারকেই রক্ষাকর্তা মনে করলেও সরকার তাদের অভাব অভিযোগের কোন প্রতিকার করেননি। তাই সার্বিক শোষণ ও অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় তারা শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহের পথ বেছে নিয়েছিল।

৬)রেল কর্মচারীদের অত্যাচার:-লর্ড ডালহৌসি শাসনকালে রাজমহল, রামপুরহাট, ভাগলপুর, সাহেবগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে রেলপথ সম্প্রসারণ এর কাজ শুরু হলে ওই সমস্ত অঞ্চলে ইংরেজ রেলকর্মচারী ঠিকাদারদের আবির্ভাব ঘটে। এরা সাঁওতালদের নামমাত্র মজুরিতে শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ করত এবং জোর করে সাঁওতালদের হাঁস, মুরগি, ছাগল কেড়ে নিত। এমনকি সাঁওতাল মহিলাদের সঙ্গেও তারা অসভ্য আচরণ করত। এই সব ঘটনায় ক্ষুব্দ হয়ে সাঁওতালরা ভদ্রলোক বিরোধী বা দিকু বিরোধী আন্দোলন শুরু করে।

৭)ধর্মীয় উন্মাদনা এবং সিধু-কানহুর নেতৃত্বদান:-সাঁওতাল বিদ্রোহের পিছনে ধর্মীয় উন্মাদনাও কাজ করেছিল। খ্রিষ্টান মিশনারীরা জোর করে সাঁওতালদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করলে সাঁওতালরা ক্ষুব্দ হয়। এমতাবস্থায় 1850 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে সাঁওতাল নেতা সিধু ও কানহু ঘোষণা করেন যে, "ঈশ্বর তাদের সামনে উপস্থিত হয়ে বিদ্রোহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই বিদ্রোহে তাদের জয় হবে। কারণ ঈশ্বর স্বয়ং তাদের হয়ে যুদ্ধ করবেন।" তারা প্রচার করেন, "ঈশ্বরের দয়ায় ইংরেজদের বুলেট নিষ্ফল হবে, যারা যুদ্ধে নিহত হবে তারা ঠাকুরের দোয়ায় আবার জীবিত হয়ে উঠবে।"এইসব বক্তব্য প্রচার নিরক্ষর ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাঁওতালদের মনে আশার সঞ্চার করে। অবশেষে 1855 খ্রিষ্টাব্দের 30 শে জুন সিধু ও কানহুর নেতৃত্বে প্রায় 10 হাজার সাঁওতাল ভাগনাডিহির মাঠে সমবেত হয়ে স্বাধীন সাঁওতাল পরগনা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা করে।

গুরুত্ব ও ফলাফল:- সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই বিদ্রোহের পর ইংরেজ কর্তৃপক্ষ সাঁওতালদের সম্পর্কে কিছুটা নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে। সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে সাঁওতাল পরগনা জেলা গঠন করা হয় এবং সাঁওতালদের পৃথক উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

২) সাঁওতাল পরগনায় সুদের হার বেঁধে দেওয়া হয় এবং মহাজনদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ইউরোপীয় মিশনারী ছাড়া অন্যান্য মিশনারীদের সাঁওতাল পরগনায় প্রবেশও নিষিদ্ধ করা হয়।

৩) সাঁওতালদের অভাব-অভিযোগের প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য সরকারি কর্মচারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে ভূমি রাজস্বের পরিমাণ হ্রাস করা হয়নি বা সাঁওতালদের জমির অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াও হয়নি।

৪) সাঁওতাল বিদ্রোহের পর সাঁওতাল পরগনায় ইউরোপীয় মিশনারী ছাড়া অন্যান্য মিশনারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হলে ইউরোপিয় খ্রিস্টান মিশনারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং সাঁওতালদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করে তাদের মনে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্য বোধ সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে ওঠেন।

৫) সাঁওতাল বিদ্রোহ কৃষক কথা সাধারণ মানুষকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা যোগায়, যা পরবর্তীকালে 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পথ প্রশস্ত করে। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের মতে, "এই বিদ্রোহ সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ভিত্তিমূল পর্যন্ত কাঁপাইয়া দিয়াছিলো এবং ইহা ছিল ভারতের যুগান্তকারী মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত স্বরূপ।

৬) অনেক ঐতিহাসিকের মতে, 1855 খ্রিষ্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল দরিদ্র জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজের মতে, "এই বিদ্রোহ ছিল সকল সম্প্রদায়ের জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধ।"কারণ সাঁওতাল যুবকরা এই বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি হলেও কামার, কুমোর, ছুতোর ও তাঁতি সম্প্রদায় কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ, এমনকি নারীরাও এই বিদ্রোহে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, যদি 1857 খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে মহাবিদ্রোহ কে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে মনে করা হয়, তবে সাঁওতালদের এই সুকঠিন সংগ্রামকেও স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া উচিত। সবশেষে ঐতিহাসিক কালীকিংকর দত্তের মতানুসারে বলা যায়, "This episode opened a new chapter in the history of Bengal and Bihar."




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

দশম শ্রেণীর ইতিহাস :: প্রথম অধ্যায়

দশম শ্রেণীর ইতিহাস ( পঞ্চম অধ্যায়)