গুপ্ত পরবর্তী যুগে ভারত
👉গুপ্ত পরবর্তী ভারত (Decline of the Gupta Empire)
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট হয় এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির বিকাশ ঘটে । সুলতানি সাম্রাজ্যের আগে ভারতে আর কোনো শক্তিশালী সাম্রাজ্যের আবির্ভাব ঘটেনি ।
৪৬৭ খ্রিস্টাব্দে স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পর গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় । এই সময়ে হুনরা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত আক্রমণ করে এবং শেষ উল্লেখযোগ্য সম্রাট বুধগুপ্ত পরাজিত হয় ও তার মৃত্যু হয় এবং হুনরা শিয়ালকোট ও পূর্ব মালয় অধিকার করে । এদিকে কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার ফলে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গুপ্ত বংশের রাজপুত্ররা স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে সুরা করেন । ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে মগধ গুপ্তদের হস্তচ্যুত হয় ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন সম্পূর্ণ হয় । এই অবস্থায় উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে কয়েকটি আঞ্চলিক শক্তির উদ্ভব ঘটে।
>>আঞ্চলিক শক্তির আত্মপ্রকাশ- পশ্চিম ও উত্তর ভারত::
►বলভীর মৈত্রিক বংশ [Maitrakas dynasty of Valbhi]: ভট্টারক পশ্চিম ভারতের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে বলভীর মৈত্রক বংশের প্রতিষ্ঠা করেন । এই বংশের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য শাসক হলেন প্রথম শিলাদিত্য, দ্বিতীয় ধ্রুবসেন ও চতুর্থ ধ্রুবসেন । দ্বিতীয় ধ্রুবসেন কনৌজের অধিপতি হর্ষবর্ধনের হাতে পরাজিত হন । এরপর বলভী রাজ্য দূর্বল হয়ে পড়ে এবং অবশেষে সপ্তম শিলাদিত্যের সময় আরবদের হাতে বলভীর পতন ঘটে ।
►যশোধর্মণ [Yasodharman]: গুপ্ত বংশের পতনের সুযোগে মান্দাশোরে যশোধর্মণ নামে একজন সামন্তরাজ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন । তিনি হুন রাজ মিহিরকুল বা মিহিরগুলকে পরাজিত করেন । মান্দাশোর লিপি থেকে জানা যায় তিনি সম্ভবত ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে আরব সাগর পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন । তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই রাজবংশের পতন ঘটে ।
►কনৌজের উত্থান - মৌখরী বংশ [Rise of Kanauj and Maukhari Dynasty] : গুপ্ত পরবর্তী যুগে মগধের পরিবর্তে কনৌজ ভারতের রাজনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। কনৌজ অবশ্য মগধের মতো কোনো সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারে নি । হরিবর্মণ কনৌজে মৌখরী বংশের প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি মহারাজ উপাধি গ্রহণ করেন । মৌখরী বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলের ইষাণবর্মণ । তিনি মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করেন । তাঁর রাজ্য গৌড় ও ওড়িশা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । অন্ধ্রের কিছু অংশও তাঁর অধিকারে ছিল, তিনিও হুনদের পরাজিত করেছিলেন বলে মনে করা হয় । এই বংশের এক জন রাজা গ্রহবর্মণ থানেশ্বরের পূষ্যভূতিরাজ প্রভাকরবর্মণের কন্যা রাজ্যশ্রীকে বিবাহ করেন । গ্রহবর্মণ গৌড়রাজ শশাঙ্কের হাতে নিহত হন । প্রভাকরবর্ধনের পুত্র রাজ্যবর্ধনও তাঁর হাতে পরাজিত ও নিহত হয় । তখন রাজ্যবর্ধনের ভাই হর্ষবর্ধনের সঙ্গে শশাঙ্কের যুদ্ধ হয় । এই যুদ্ধে হর্ষবর্ধনের সাফল্য নিয়ে সন্দেহ আছে । যাই হোক, কনৌজের সিংহাসন শূন্য হওয়ায় কনৌজ হর্ষের রাজ্যভুক্ত হয় ।
►পুষ্যভূতি বংশ ও হর্ষবর্ধন [Pushyabhuti Dynasty and Harshavardhana] (৬০৬ - ৬৪৬/৪৭): থানেশ্বরের পুষ্যভুতিবংশের রাজা প্রভাকরবর্ধনের কনিষ্ঠ পুত্র হর্ষবর্ধন এক চরম সংকটের মুহুর্তে সিংহাসনে বসেন । তিনি একই সঙ্গে থানেশ্বর ও কনৌজের সিংহাসন লাভ করেন । ভগিনী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করলেও যতদিন শশাঙ্ক জীবিত ছিলেন, ততদিন তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি । তাঁর মৃত্যুর পর তিনি মগধ, গৌড়, ওড়িশা ও কঙ্গোদ নিজ রাজ্যভুক্ত করেন । তিনি বলভিরাজ ধ্রুবসেনকে যুদ্ধে পরাজিত করেন । হর্ষবর্ধন তাঁর কন্যার সঙ্গে ধ্রুবসেনের বিবাহ দেন এবং বলভির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন । এদিকে চালুক্য রাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর হাতে পরাজয়ের ফলে তাঁর দক্ষিণ ভারত অভিযান ব্যর্থ হয় । উত্তর ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল তিনি কুক্ষিগত করেছিলেন বলে চালুক্যলিপিতে তাঁকে “সকলোত্তরপথনাথ” বলা হয়েছে । হিউয়েন-সাঙ তাঁকে “পঞ্চভারতের অধিপতি” বলে উল্লেখ করেছেন। উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে নর্মদা পর্যন্ত এবং পূর্বে গঞ্জাম থেকে পশ্চিমে বলভী পর্যন্ত সমগ্র এলাকা হর্ষবর্ধনের অধীন ছিল । দয়ালু, শিক্ষানুরাগী ও বিদ্যোৎসাহী নরপতি হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল । তিনি রত্নাবলী ও প্রিয়দর্শিকা নামে দুটি নাটক রচনা করে ছিলেন ।
►প্রতিহার বংশ [Pratihar Kingdom] : হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর প্রতিহার বংশ উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রভাব শালী হয়ে পড়ে। প্রতিহার বা গুর্জর প্রতিহাররা ছিল রাজপুত জাতির একটি শাখা । এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হরিচন্দ্র, কিন্তু বৎসরাজের আমলেই প্রতিহাররা একটি সর্বভারতীয় শক্তিতে উন্নীত হয় । তিনি ধর্মপাল ও ধ্রুবর সঙ্গে কনৌজের দখল নিয়ে একটি ত্রি-শক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন । তিনি ধর্মপালকে পরাজিত করেন এবং ধ্রুবর হাতে পরাজিত হন । বৎসরাজের পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্টের আমলেও এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা অব্যাহত ছিল । এ ক্ষেত্রেও ধর্মপাল পরাজিত হলেও রাষ্ট্রকূট রাজ তৃতীয় গোবিন্দের হাতে নাগভট্টের পরাজয় ঘটে । প্রথম ভোজ বা মিহিরভোজ ছিলেন এই বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা । কনৌজের অধিকার নিয়ে যে ত্রি-শক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল, তাতে শেষ পর্যন্ত প্রতিহাররা জয়লাভ করে ও তারা কনৌজ অধিকার করে । কিন্তু মহীপালের আমলে রাষ্ট্রকূট রাজ তৃতীয় ইন্দ্র কনৌজ ধ্বংস করে প্রয়াগ পর্যন্ত অগ্রসর হন, মহীপালের পর প্রতিহারদের পতন শুরু হয় । সুলতান মামুদ কনৌজ লুন্ঠন করেন । চান্দেলদের হাতে প্রতিহারদের পতন সম্পূর্ণ হয় ।
অন্যান্য শক্তির উদ্ভব: হর্ষের মৃত্যুর পর উত্তর ভারতে অন্যান্য যে সব শক্তির উদ্ভব ঘটে, তাদের মধ্যে রাজপুত, আজমির ও দিল্লির চৌহান বংশ, চান্দেল, চেদী, পারমার প্রভৃতি নাম উল্লেখযোগ্য
►দক্ষিণ ভারত [The Deccan]::
উত্তর ভারতের মতো দক্ষিণ ভারতেও বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকত । ফলে দক্ষিণ ভারতে কোনো অখন্ড সাম্রাজ্যের উদ্ভব হয়নি । বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণ থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত অঞ্চলকে সাধারণভাবে দক্ষিণ ভারত মনে করলেও তুঙ্গভদ্রা নদী এই অঞ্চলকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে । উত্তর অঞ্চলকে দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভাগকে সুদূর দক্ষিণ বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে । দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসের একটি বৈশিষ্ট্য হল পশ্চিমদিকের মালভূমি অঞ্চলের রাজ্যগুলি গোদাবরী ও কৃষ্ণার বদ্বীপ অঞ্চল দখল করার চেষ্টা সবসময়ই করেছে । এই অঞ্চল ছিল তাই বিভিন্ন রাজ্যের বিরোধিতার মূল কারণ ।
►বাতাপির চালুক্য বংশ [Chalukya Kingdom of Vatapi] : উত্তর মহারাষ্ট্র ও বিদর্ভে বাকাটকদের পতনের পর চালুক্য বংশের উদ্ভব হয় । প্রথম পুলকেশী [Pulakesin -I] ৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে বাতাপিপুরে (বর্তমান বিজাপুরের বাদামি) রাজধানী স্থাপন করে বাতাপির চালুক্য বংশের প্রতিষ্ঠা করেন । এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা দ্বিতীয় পুলকেশী [Pulakesin II] ৬০৯ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন ও ৬৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । তাঁর সভাকবি রবিকীর্তি রচিত আইহোল লিপি থেকে তাঁর কথা জানতে পারা যায় । নর্মদা থেকে কাবেরী পর্যন্ত অঞ্চল তাঁর অধীনে ছিল । তিনি হর্ষবর্ষন ও কাঞ্চীর রাজা মহেন্দ্রবর্মনকে পরাজিত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পল্লবদের হাতে পরাজিত ও নিহত হন এবং তাঁর রাজধানী বিধ্বস্ত হয় । এই বংশের শেষ উল্লেখযোগ্য রাজা দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর এই বংশের পতন হয় ।
►রাষ্ট্রকূট বংশ [Rashtrakuta Dynasty]: চালুক্যদের পতনের পর রাষ্ট্রকূটদের উদ্ভব হয় । চালুক্যরাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মণকে পরাজিত করে দন্তিদূর্গ [Dantidurga] রাষ্ট্রকূট বংশের প্রতিষ্ঠা করেন । ঠিক কত খ্রিস্টাব্দে দন্তিদূর্গ সিংহাসনে বসেন তা পরিষ্কার ভাবে বলা যায় না । ডঃ আর. সি. মজুমদারের মতে ৭৫৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দন্তিদূর্গ দাক্ষিনাত্যের সুবিশাল অংশের অধীশ্বর হয়েছিলেন । রাষ্ট্রকূট রাজারা কনৌজের অধিকার নিয়ে পাল ও প্রতিহারদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করে । কিন্তু তাঁরা একাধিক বার উভয় প্রতিপক্ষকেই পরাজিত করলেও উত্তর ভারতে প্রাধান্য স্থাপন করতে ব্যর্থ হন । রাষ্ট্রকূট বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন তৃতীয় গোবন্দ [Gobinda III] । তৃতীয় কৃষ্ণ (Krishna III) ছিলেন এই বংশের শেষ শক্তিশালী রাজা । তৃতীয় কৃষ্ণ ৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন এবং ৮১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন ।
►কল্যাণীর চালুক্য বংশ [Chalukya Kingdom of Kalyana]: রাষ্ট্রকূট বংশের শেষ রাজা দ্বিতীয় কর্ককে পরাজিত ও নিহত করে ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় তৈল [Taila II] কল্যাণীর চালুক্য বংশ প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি কর্ণাটক, তাঞ্জোর ও মালবের রাজাকে পরাজিত করেন । চালুক্য ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল চোলদের সঙ্গে তাদের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম । চালুক্য রাজাদের মধ্যে প্রথম সোমেশ্বর, দ্বিতীয় সোমেশ্বর ও ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের [Vikramaditya VI] নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য । ১০৭৬ খ্রিস্টাব্দে ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য [Vikramaditya VI] সিংহাসনে বসেন । কল্যাণীর চালুক্য বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য । তিনি চালুক্য বিক্রম যুগ নামে নতুন যুগের সূচনা করেন । ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের রাজ্যবিস্তার ও শাসনব্যবস্থা সম্মন্ধে বহু তথ্য তাঁর সভাকবি বিল্হন রচিত বিক্রামাঙ্কদেবচরিত গ্রন্থ থেকে জানা যায় ।
►কাঞ্চীর পল্লব বংশ [The Pallavas of Kanchi]:
১) সিংহবিষ্ণুর [Simhavishnu]: সাতবাহন বংশের পতনের পর কৃষ্ণা থেকে পালার নদী পর্যন্ত অঞ্চলে পল্লবদের রাজ্য স্থাপিত হয় । তাদের রাজধানীর নাম ছিল কাঞ্চী । কাঞ্চিতে পল্লব বংশের উদ্ভব কবে হয়েছিল তা পরিষ্কার করে কিছু জানা যায় নি । তবে পল্লবরাজ সিংহবিষ্ণুর [Simhavishnu] সিংহাসনে আরোহণের সময়কাল থেকে পল্লব বংশের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয় । সিংহবিষ্ণু প্রায় ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । পল্লবরাজ সিংহবিষ্ণুই প্রথম পল্লব সাম্রাজ্যবাদের সূচনা করেন । পল্লবরাজ সিংহবিষ্ণু কাবেরী নদী পর্যন্ত অঞ্চলে তাঁর প্রাধান্য বিস্তার করেন । বিখ্যাত কবি ভারবি তাঁর সমসাময়িক ছিলেন ।
২) প্রথম মহেন্দ্রবর্মন [Mahendravarman- I]: সিংহবিষ্ণুর পর তাঁর পুত্র প্রথম মহেন্দ্রবর্মন সিংহাসনে আরোহণ করেন । প্রথম মহেন্দ্রবর্মন ৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব । প্রথম মহেন্দ্রবর্মন ও শিল্প, সংগীত, ও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন । তাঁর আমলে পল্লব চালুক্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় । চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর হাতে প্রথম মহেন্দ্রবর্মন যুদ্ধে নিহত হন ।
৩) প্রথম নরসিংহবর্মন[Narasimhavarman- I]: প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম নরসিংহবর্মন সিংহাসনে বসেন । তিনি ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । তাঁর সময় পল্লব বংশ ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করে । তিনি চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীকে যুদ্ধে পরাজিত করে পল্লব বংশের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করেন ও ‘মহামল্ল’ উপাধি ধারন করেন । তাঁর সময় চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং (Hiuen Tsang) কাঞ্চির রাজসভায় কিছুকালের জন্য অবস্থান করেন । হিউয়েন সাং প্রথম নরসিংহবর্মনের রাজ্যশাসন সম্মন্ধে সুন্দর বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন । গঙ্গরাজ্য, চোল, কেরল, পান্ড্য প্রভৃতি রাজ্য তাঁর অধীনস্থ হয় । মহাবলীপুরমের মন্দিরগুলি তাঁর সময়ে নির্মিত হয় ।
৪) অপরাজিতবর্মণ [Aparajitavarman] : অপরাজিতবর্মণ ছিলেন এই বংশের শেষ রাজা । নবম শতকের শেষের দিকে চোল রাজের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হন । এই পরাজয়ের পর পল্লব বংশের পতন সম্পূর্ণ হয় ।
►তাঞ্জোরের চোল বংশ [The Cholas of Tanjore]:
(১) বিজয়ালয় [Vijayalaya] ছিলেন চোল বংশের প্রতিষ্ঠাতা । বিজয়ালয় প্রথম জীবনে পল্লবদের অধীনে একজন করদ রাজা ছিলেন । নবম শতকের মধ্যভাগে তিনি তাঞ্জোরে নিজেকে স্বাধীন রাজা বলে ঘোষণা করেন ।
(২) এরপর আদিত্য চোল, প্রথম পরান্তক (৯০৭-৯৫৫) ও দ্বিতীয়পরান্তকের (৯৫৭-৯৭৩) রাজত্বকালে চোল শক্তি সাবালকত্ব পায় । তাদের অধিকার মাদুরা পর্যন্ত বিস্তৃত হয় ।
(৩) প্রথম রাজরাজ [Rajaraja- I] চোল শক্তি দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় । তিনি ৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । প্রথম রাজরাজের সিংহাসনে আরোহণের পর থেকে চোল বংশের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয় । তিনি তাঁর সময়কালে নিজেকে সমগ্র দক্ষিণ ভারতের অধীশ্বরে পরিণত করেন । তিনি চেরদের (কেরল) পরাজিত করার পাশাপাশি বেঙ্গি, গঙ্গাবধি, কলিঙ্গ, সিংহল, মালদ্বীপ জয় করেন । তাঞ্জোরের রাজরাজেশ্বর মন্দির তিনিই নির্মাণ করেন ।
(৪) রাজেন্দ্র চোল [Rajendra Chola]: রাজেন্দ্র চোল প্রথম রাজেন্দ্র নামেও পরিচিত ছিলেন । চোল বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন রাজরাজের পুত্র রাজেন্দ্র চোল । তিনি ১০১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । মাদুরা, সিংহল, আদিনগর, ওড়িশা প্রভৃতি অঞ্চল তাঁর অধীনে ছিল । তিনি চালুক্যদের পরাজিত করে তুঙ্গভদ্রা নদী পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করেন । তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল রাঢ়-বঙ্গ আক্রমণ । তিনি পাল রাজ প্রথম মহীপালকে পরাজিত করে গঙ্গইকোন্ড উপাধি গ্রহণ করেন । অবশ্য বাংলায় তাঁর আধিপত্য বেশি দিন স্থায়ী হয় নি । ভারতের বাইরে তিনি মালয়, সুমাত্রা, পেনাঙ্গ ও নিকবর দ্বীপপুঞ্জে অভিযান পাঠান । দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শৈলেন্দ্র বা শ্রীবিজয় রাজ্য তাঁর আধিপত্য স্বীকার করে । চোল নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করে ভারতের ইতিহাসে তিনিই প্রথম ঔপনিবেশিক সম্রাট হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ।
(৫) রাজেন্দ্র চোলের মৃত্যুর পর চোল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় । চালুক্যদের সঙ্গে বিবাদে তাদের শক্তি ক্ষয় হতে থাকে ও দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি পতন সম্পূর্ণ হয়।।
👉 বাংলা 👈
►শশাঙ্ক [Sasanka]:: (৬০৬-৬৩৭): শশাঙ্ক ৬০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর গৌড়রাজ শশাঙ্কের আমলে বাংলা প্রথম সর্বভারতীয় রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে । সম্ভবত তিনি পরবর্তী কোনো গুপ্ত রাজার সামন্ত ছিলেন । গৌড় বলতে তখন প্রধানত উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গের কিছু অংশকে বোঝাত । তাঁর রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণতে । তিনি থানেশ্বর ও কামরূপে সাহায্যপুষ্ঠ মৌখরী রাজ গ্রহবর্মণকে পরাজিত করেন । মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি গৌড়, মগধ, উৎকল, কঙ্গোজ প্রভৃতি অধিকার করেছিলেন।
►পাল বংশ- ধর্মপাল [Pal Dynasty and Dhamapala] : শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলায় এক রাজনৈতিক অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ায় গোপাল রাজা নির্বাচিত হন । পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের সুযোগ্য পুত্র ধর্মপাল প্রথমে প্রতিহার রাজ বৎসরাজ ও পরে রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুবর হাতে পরাজিত হন । কিন্তু তা সত্ত্বেও অবন্তী, কীর, মদ্র, মংস্য, যদু, ভোজ, পুরু, গান্ধার প্রভৃতির রাজারা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন বলে খলিমপুর লিপিতে দাবি করা হয়েছে । বাংলা ও বিহার তাঁর প্রত্যক্ষ শাসনাধীন ছিল । ধর্মপাল সম্ভবত গোকর্ণ বা নেপালও জয় করেছিলেন । ধর্মপাল ৭৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৮১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন ।
►দেবপাল [Devpala] : ধর্মপালের পুত্র দেবপাল পাল বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন । দেবপাল ৮১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৮৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত এবং পূর্বে কামরূপ থেকে পশ্চিমে কাশ্মীর ও পাঞ্জাব পর্যন্ত তাঁর রাজ্য বিস্তৃত ছিল । তিনি হুনদের পরাজিত করেন । প্রতিহাররাজ রামচন্দ্র ও প্রথম ভোজ এবং রাষ্ট্রকূট রাজ অমোঘবর্ষ তাঁর হাতে পরাজিত হন ।
►সেন বংশ [The Sena Kingdom]:
(১) পাল বংশের শেষ রাজা মদন পালকে পরাজিত করে বিজয় সেন [Vijaysena] সেন বংশের প্রতিষ্ঠা করেন । বিজয় সেন ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন ।
(২) তাঁর পুত্র বল্লাল সেন ছিলেন এই বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান । তিনি মগধ ও মিথিলা জয় করেন । কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তক হিসাবে বল্লাল সেন বাংলার ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন । তিনি দানসাগর ও অদ্ভূতসাগর নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন ।
(৩) বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষ্মণ সেনের [Lakshmanasena] আমলে তুর্কি সেনাপতি বক্তিয়ার খলজি বাংলা আক্রমণ করেন । বৃদ্ধ লক্ষ্মণ সেন সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেন নি । ড. নীহাররঞ্জন রায়ের ভাষায় “বক্তিয়ারের নবদ্বীপ জয় এবং একশ বছরের মধ্যে সারা বাংলাদেশ জুড়ে মুসলমান রাজশক্তির প্রচেষ্টা মোটেই আকস্মিক ঘটনা নয় । সেন আমলের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধোগতিরই অনিবার্য পরিণাম” ।।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন