বৈদিক সভ্যতার ইতিহাস
বৈদিক সভ্যতা [Vedic Civilisation]::
► আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস ও আর্য সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু উভয় সভ্যতার মধ্যে সম্পর্ক, কোনটি আগে, কোনটি পরে বা আর্যরাই সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা কিনা, আর্যদের আদি বাসস্থান ভারতে, না তারা বহিরাগত— এইসব প্রশ্ন নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বাগবিতণ্ডার অন্ত নেই। এসব প্রশ্নের সর্বজনগ্রাহ্য কোনো উত্তর হয় না । বেদ ছিল আর্য মনীষার প্রধান ফসল এবং বেদ থেকেই আমরা আর্যসভ্যতার পরিচয় পাই। তাই এই সভ্যতাকে বৈদিক সভ্যতা বলা হয় । ঋক্বেদের সময় থেকেই ভারতে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়। ঋক্বেদ কবে রচিত হয়েছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না । ম্যাক্সমুলারের মতে, এর রচনা কাল খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে। বালগঙ্গাধর তিলকের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ অব্দ । দ্বিতীয় মতটি কেউই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না। যাই হোক, সাধারণভাবে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে ঋক্বেদ রচিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। এই যুগকে তাই ঋক্বৈদিক যুগ বলা হয়। ঋক্বৈদিক যুগের পরবর্তী যুগকে পরবর্তী-বৈদিক যুগ বলা হয়।
আর্যদের বসতি বিস্তার :
আর্যরা প্রথমে সপ্ত সিন্ধু অঞ্চলে (পাঞ্জাবের পাঁচটি নদী এবং সিন্ধু ও সরস্বতী উপত্যাকা; অর্থাৎ, কাশ্মীর, পাঞ্জাব ও সিন্ধু সহ উত্তর-পশ্চিম ভারত) বসবাস করত । কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ও যাযাবর বৃত্তি পরিত্যাগ করে কৃষিকার্যকে উপজীবিকা হিসাবে গ্রহণ করার পর তারা পূর্ব দিকে গঙ্গা-যমুনা বিধৌত অঞ্চলে বন কেটে বসতি স্থাপন করে । এই ভাবে বৈদিক যুগের শেষে তারা বিহার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে । পরে তারা বিন্ধ্য পর্বত অতিক্রম করে দক্ষিণ ভারতের দিকেও অগ্রসর হয়।
ঋক্বেদের যুগে আর্য জনজীবন: [Life of the People as reflected in the Vedic Literature]
►রাজনৈতিক জীবন [Political Life of The Aryans] :
বৈদিক যুগে কোনো বড়ো রাষ্ট্র বা সম্রাজ্যের উদ্ভব হয়নি। কয়েকটি পরিবার নিয়ে গঠিত হত গ্রাম । কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত হত বিশ এবং বিশের সমষ্টিকে বলা হত জন । গ্রামের প্রধান গ্রামনি, বিশের প্রধান বিশপতি এবং জনের প্রধান ছিল গোপা । গ্রাম, বিশ ও জনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কী ছিল তা বলা কঠিন । সম্ভবত সবার নীচে ছিল গ্রাম এবং জনের স্থান ছিল বিশের ওপরে । বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রচলিত রাষ্ট্রকাঠামো হলেও গণ বা প্রজাতান্ত্রিক শাসনও অজ্ঞাত ছিল না । গণের অধিপতিকে বলা হয় গণপতি বা জ্যেষ্ঠ । রাজার প্রধান কর্তব্য ছিল জনজীবনের নিরাপত্তা বিধান করা ও বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা । গুপ্তচরের মারফত তিনি রাজ্যের খবরাখবর রাখতেন ও দোষীকে শাস্তি দিতেন । ধর্মীয় আচারঅনুষ্ঠান ও উপদেশের জন্য তিনি পুরোহিতের উপর নির্ভর করতেন । তাঁকে সাহায্য করতেন বিভিন্ন কর্মচারী । সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন সেনানি । অশ্বারোহী, পদাতিক ও রথীরা যুদ্ধে অংশ নিলেও সম্ভবত হাতির ব্যবহার ছিল অপ্রচলিত । তির, ধনুক, বর্শা, তরবারি ও কুঠার ছিল প্রধান যুদ্ধাস্ত্র । রাজা সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেও জনমত উপেক্ষা করতেন না । বৈদিক যুগে সভা ও সমিতির উল্লেখ পাওয়া যায় । সমিতির অধিবেশনে রাজপুত্র ও জনগণ অংশ নিতেন । সভা ছিল বয়ষ্কদের পরিষদ ।
►সামাজিক জীবন-[Social Life of The Aryans]::
(১) পারিবারিক জীবন [Family Life]:
আর্য সমাজের ভিত্তি ছিল পরিবার । গৃহের অধিপতিকে বলা হত গৃহপতি বা দম্পতি । তিনি দয়াবান ও স্নেহশীল হলেও কিছু কিছু নিষ্ঠুরতার পরিচয় পাওয়া যায় । সাধারণভাবে পরিবার গুলি ছিল যৌথ । পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থায় পুত্র সন্তানের জন্ম ছিল কাম্য । কন্যা সন্তানের যত্ন ও লালনপালনেও কোনো ত্রুটি হত না । তাদের শিক্ষার দিকেও নজর দেওয়া হত । গোপা, অপালা, মমতা, লোপামুদ্রা প্রভৃতি বিদুষী রমণী এই যুগেই আবির্ভূত হয়েছিলেন । উপযুক্ত সময়ে কন্যাদের বিবাহ দেওয়া হত । পণপ্রথা প্রচলিত ছিল । বিবাহ অনুষ্ঠান হত কন্যার পিতৃগৃহে । পুরুষদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রচলিত থাকলেও নারীদের মধ্যে তা অপ্রচলিত ছিল । বিধবাবিবাহও প্রচলিত ছিল । সমাজ ও আইনের চোখে নারীরা স্বাধীন ছিলেন না । তাঁরা স্বামীর সহধর্মিণী ছিলেন । তখন পর্দা প্রথার প্রচলন ছিল না । সতীদাহ প্রথা ছিল না । বিধবাবিবাহ নিন্দনীয় ছিল না ।
(২) পোশাক পরিচ্ছদ [Garments]:
পোশাক পরিচ্ছদ ও অলংকারে তাদের সুরুচির পরিচয় পাওয়া যায় । আর্যদের পোশাক তিনভাগে বিভক্ত ছিল, যথা— নিবি বা এক ধরনের অন্তর্বাস, বাস বা পরিধান ও অধিবাস বা দ্রাপি (ওড়না) । এইসব পোশাক তৈরি হত সুতো, পশম ও হরিণের চামড়া দিয়ে । সোনা ও ফুলের তৈরি গহনা আর্যদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল । উৎসবের দিনে নারী পুরুষ উভয়েই পাগড়ি পরত । আর্যরা বড় চুল রাখতে ভালোবাসত ও চিরুনি দিয়ে তা সুবিন্যস্ত করত ।
(৩) খাদ্য [Food Habit]:
শস্য, দুধ ও দুধের তৈরি খাবার এবং ফলমূল ছিল আর্যদের প্রধান খাদ্য । গো-মাংসে আর্যদের অরুচি ছিল না । পরে অবশ্য বলদে টান পড়ায় গো-মাংস ভক্ষণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য । আর্যরা কিন্তু নুনের ব্যবহার জানত না । আর্যরা পানীয় জল সংগ্রহ করত নদী ও ঝরনা থেকে । তবে তারা কূপ খনন করতেও জানত । আর্যরা সুরা ও সোমরস পান করত । তবে সুরাপান ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট ছিল ।
(৪) আমোদপ্রমোদ [Recreation]:
আর্য সমাজে আমোদপ্রমোদের উপকরণ ছিল পশু শিকার, কুস্তি, পাশা, রথের দৌড়, নাচগান ইত্যাদি । হাতি, সিংহ, বন্য শূকর, হরিণ ইত্যাদি ছিল শিকার করার পশু । আর্যরা এত আনন্দ করতে ভালোবাসত যে, মৃত্যু চিন্তা করত না । মৃত দেহ দাহ করা হত । বৈদিক যুগে সবকিছু ভাল ছিল না । হিংসা, শঠতা, চুরি, ডাকাতি, বৃদ্ধ বাবার সম্পত্তি গ্রাস– এ সব কিছুই ছিল ।
(৫) সামাজিক কাঠামো [Social System]:
আর্যসমাজ ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র– এই চার ভাগে বিভক্ত ছিল । এই প্রভেদ ছিল বর্ণগত ও বৃত্তিগত । বংশানুক্রমিক জাতিভেদ প্রথা এ সময় ছিল না । তাই বিয়ে ও মেলামেশার ব্যাপারে কোনো বিধি নিষেধ ছিল না। বৃত্তি পরিবর্তনের সুযোগও ছিল । আর্যসমাজে চতুরাশ্রম প্রচলিত ছিল । ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, ও বৈশ্যকে ব্রম্ভচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস- এই চারটি আশ্রমের বিধিনিষেধ মেনে চলতে হত । চতুরাশ্রম [Four Stages of Life] ব্যবস্থা আর্যদের সামাজিক জীবনের শৃঙ্খলা ও উচ্চনৈতিক মূল্যবোধের সাক্ষ দেয় ।
►আর্যদের অর্থনৈতিক জীবন- [Economic life of the Aryans]::
(১) কৃষি ও পশুপালন [Agriculture and Animal husbandry] :
আর্য সভ্যতা ছিল গ্রামীণ সভ্যতা । বৈদিক মন্ত্রে নগরের উল্লেখ পাওয়া যায় না । তবে সামরিক নগর, দুর্গ বা পুরের কথা জানা যায় । আর্যরা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গ্রামে বাস করত বলে তাদের অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর । তারা অবশ্য পশুপালনও করত । কর্ষণযোগ্য ভূমিকে বলা হত ভূমি বা উর্বরা । কৃষিতে জলসেচের ব্যবস্থা ছিল। সারের ব্যবহার অজ্ঞাত ছিল না । উৎপন্ন শস্যকে বলা হত ধান বা যব । তবে শব্দ দুটির প্রকৃত অর্থ কী ছিল, তা বলা দুরূহ । কৃষিক্ষেত্র ও বাস্তুজমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত ছিল । কিন্তু গোচারণের জন্য খাস জমির ওপর যৌথ মালিকানা ছিল । তবে জমির মালিকানা প্রসঙ্গে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে । গৃহপালিত পশুর মধ্যে গোরু, কুকুর, ছাগল, ঘোড়া ও ভেড়া ছিল প্রধান ।
(২) ব্যবসাবাণিজ্য [Trade and Commerce] ::
কৃষিকার্য ও পশুপালন ছাড়া আর্যরা ব্যবসাবাণিজ্যও করত । পনি নামে এক শ্রেণীর মানুষ এই কাজে লিপ্ত ছিল । কাপড় ও চামড়া ছিল বাণিজ্যের প্রধান উপকরণ । বিনিময় প্রথার মাধ্যমে ব্যাবসাবাণিজ্য চলত । গো-ধন ছিল বিনিময়ের মাধ্যম । অবশ্য এই যুগে ‘নিষ্ক’ও ‘মনা’ নামে ধাতব মুদ্রার কথা জানা যায় । স্থলপথে ঘোড়ায় টানা রথ ও বলদচালিত গাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায় । সমুদ্রপথে ব্যবসাবাণিজ্য চলত কিনা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকরা একমত নন ।
(৩) শিল্প [Crafts] ::
আর্যদের প্রধান শিল্পকর্মের মধ্যে ছিল মৃৎশিল্প, বস্ত্রবয়ন শিল্প, চর্মশিল্প । কারিগররা রথ, নৌকা, বাড়ি তৈরি করা ছাড়াও সূক্ষ খোদাই করা পাত্র তৈরি করত । কামারেরা লোহা দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ও যন্ত্রপাতি তৈরি করত । স্যাকরা তৈরি করত সোনার গয়না ।
►আর্যদের ধর্মজীবন [Religious life of the Ariyans] :
আর্যরা কোনো মূর্তিপূজা করত না । বৈদিক যুগে ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য একেশ্বরবাদ । তারা ছিল প্রকৃতির উপাসক । প্রাকৃতিক শক্তিকে তারা দেবতারূপে কল্পনা করত । আর্যদের দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্র (বজ্রের দেবতা), অগ্নি, বরুন (বৃষ্টির দেবতা), সোম প্রভৃতি ছিল প্রধান । দেবীর মধ্যে পৃথিবী, অদিতি, সরস্বতী ও উষা ছিলেন সবিশেষ উল্লেখযোগ্য । আর্যধর্মের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল পুরুষ দেবতার প্রাধান্য । আর্যদের দেবদেবীর সংখ্যা অনেক হলেও তারা মনে করত সকল দেবতা একই মহাশক্তির বিভিন্ন প্রকাশ । যাগযজ্ঞ ও আহুতি বা অঞ্জলি প্রদান ছিল আর্যধর্ম আচরণের প্রধান অঙ্গ । যজ্ঞে মন্ত্র উচ্চেরণ করে ঘি, দুধ, চাল, মাংস ও সোমরস উৎসর্গ করা হত । যজ্ঞে পৌরহিত্যের কাজ করতেন ব্রাহ্মণরা । পরলোক তত্ত্ব সম্পর্কে আর্যদের ধারণার কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ঋক্বেদের স্তোত্রে পাওয়া যায় না । কিছু কিছু স্তোত্র থেকে জানা যায় যে, আর্যদের ধারনা ছিল মৃত্যুর পর মানুষ যমালয়ে বাস করে ।
►পরবর্তী বৈদিক যুগ [The Later Vedic Age]::
পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যজীবনে কয়েকটি পরিবর্তন ঘটেছিল।
(ক) রাজার ক্ষমতা [Power of the Kings] : পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছিল । এমনকি তাঁরা ব্রাহ্মণদের বিতাড়িত করতে পারতেন। এই সময় তারা রাজসূয়, বাজপেয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞ করতেন ‘সম্রাট’ও ‘একরাট’উপাধি ধারণ করে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করতেন। তবে তাঁরা দেশে প্রচলিত আইন মেনে চলতেন ও ব্রাহ্মণদের রক্ষা করতেন । এই সময় শাসনতান্ত্রিক কাঠামো জটিলতর হয়েছিল এবং বিভিন্ন পদের সৃষ্টি হয়েছিল।
(খ) সামাজিক কাঠামোতে পরিবর্তন [Changes of the Social Stucture] :
এই সময় আর্যদের জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হল বর্ণাশ্রম প্রথার কঠোরতা । বৈশ্য ও শূদ্রদের তুলনায় ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছিল । বৃত্তি পরিবর্তনের সুযোগ থাকলেও এই সময় তা সহজসাধ্য ছিল না। শূদ্ররা অপবিত্র বলে গণ্য হত । এই যুগে নারীদের অবস্থারও অবনতি হয়ে ছিল । বাল্যবিবাহের সূত্রপাত হয় । অথর্ব বেদে দুটি সতীদাহের উল্লেখ আছে ।
(গ) অর্থনৈতিক জীবনে পরিবর্তন [Changes in the Economic Life]:
এই সময় আর্যদের অর্থনৈতিক জীবনেও কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল। বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বাস করলেও এই সময় কয়েকটি শহর গড়ে উঠেছিল । কিছু কিছু গ্রামে এই সময় জমিদার শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল । এই সময় কৃষিব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল । বিভিন্ন ধরনের শস্য ও ফলের উৎপাদন শুরু হয় । ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটেছিল ।
(ঘ) ধর্ম ও ধর্মীয় আচারে পরিবর্তন [Changes in the Religious Life] :
পরবর্তী বৈবিক যুগে যাগযজ্ঞের জটিলতা বৃদ্ধি পায় । সমাজে বিভিন্ন কুসংস্কার ও ডাইনি প্রথার প্রচলন শুরু হয় । একদিকে যেমন পুরোহিত সম্প্রদায়ের প্রাধান্য দেখা যায় এবং ধর্ম আচরণে বিভিন্ন প্রথার ওপর জোর দেওয়া হয়, অন্যদিকে তেমনি দার্শনিকরা পূজা-অর্চনার প্রথাগত দিকটির উপযোগিতা ও কার্যকারিতা সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলেন । ঋক্বৈদিক যুগের অনেক দেবতা এই সময় গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন । এই সময়ে প্রজাপতি ব্রহ্মা, রুদ্র ও বিষ্ণু শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হন ।
►বৈদিক সাহিত্য [Vedic Literature]::
বৈদিক সাহিত্য বলতে মূলত চারটি বেদকে বোঝায়- ঋক্, সাম, যজু, ও অথর্ব । বেদ কথাটির আক্ষরিক অর্থ জ্ঞান । প্রত্যেক বেদের চারটি ভাগ আছে- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ । আর্যরা মনে করত বেদ অপৌরুষের, অর্থাৎ, মানুষ্যসৃষ্ট নয় । এই জ্ঞান ঈশ্বর প্রদত্ত । বেদের অপর নাম শ্রুতি, কারণ ঈশ্বর তা মানুষের সরাসরি কর্ণগোচর করেছেন । আচার্য ও শিষ্য পরম্পায় মুখে মুখে বেদ পাঠ করে তা মুখস্ত করতে হত বলেও তাকে শ্রুতি বলে অভিহিত করা হয় । ঋক্বেদ সর্বপ্রথম রচিত হয়, ঋক্বেদের সম্ভাব্য রচনাকাল ১২০০ - ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ । সব শেষে রচিত হয় অথর্ব বেদ । এতে সৃষ্টি রহস্য, চিকিৎসা মন্ত্র ইত্যাদি বিবৃত হয়েছে । বেদ ছাড়া বেদাঙ্গ বা স্মৃতিও বৈদিক সাহিত্যের অন্তর্গত । বেদাঙ্গ ছটি ভাগে বিভক্ত- শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ ।
►প্রাচীন ভারতে বাণিজ্যের প্রসার [Expansion of Trade in Ancient India] ::
পশুপালন যখন আর্যদের প্রধান উপজীবিকা তখন ব্যাবসাবাণিজ্যের বিশেষ সুযোগ ছিল না । ঋক্বেদে ব্যাবসাবাণিজ্য সংক্রান্ত তথ্য তাই খুব বেশি পাওয়া যায় না । তবে ঋক্বেদ থেকে জানা যায় যে, অর্থ উপার্জনের তাগিদে বণিকরা দূর দেশে যেত । যাত্রাপথ অবশ্যই দুর্গম ছিল ও দস্যু, চোর, ডাকাতের আশঙ্কা ছিল । তাই যাত্রারম্ভে বণিকরা বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করত । ঋক্বেদে ‘পনি’ কথাটি সম্ভবত বণিক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে । তাদের অর্থকরী অবস্থা যথেষ্টই ভালো ছিল; কিন্তু সামাজিক মর্যাদা ছিল না । বণিকরা সামুদ্রিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করত কিনা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে । ঋক্বেদে ‘সমুদ্র’ কথাটি উল্লিখিত হয়েছে । কিন্তু সমুদ্র বলতে কিথ সিন্ধু মোহনার বিপুল জলরাশিকে বুঝিয়েছেন । আবার ম্যাক্সমুলার, লাসেন ও জিমার তাঁর বিরোধিতা করেছেন । যাই হোক, সমুদ্র আর্যদের কাছে হয়তো অজ্ঞাত ছিল না । কিন্তু বাণিজ্যিক কারণে তারা সমুদ্রে পাড়ি দিত বলে মনে হয় না, কারণ সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার মত উপযুক্ত জলযানের কথা ঋক্বেদে উল্লিখিত হয়নি । তা ছাড়া তখন এত বেশি পরিমাণে উৎপাদন হত না যা দিয়ে সামুদ্রিক বাণিজ্য সম্ভব ছিল ।
কিন্তু যখন থেকে চাষবাস শুরু হল, শিল্প ও বিভিন্ন পেশার উদ্ভব হল, তখন থেকে বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটল । নদীপথ ধরে ব্যবসা চলত এবং নদীতীরে গড়ে উঠল বাণিজ্য কেন্দ্র । যে সব বড়ো ও সম্পন্ন জমির মালিক অন্যদের দিয়ে জমিজমা চাষ করাত, তারাই ক্রমশ ব্যবসার দিকে ঝুঁকল । কারণ, তাদের হাতেই ছিল প্রচুর ধনসম্পদ ও অখন্ড অবসর । প্রথম প্রথম তারা স্থানীয় অঞ্চলে ব্যবাসা করত । পরে তারা দূরবর্তী অঞ্চলের দিকেও নজর দিল । ব্যবসা চলত বিনিময় প্রথার মাধ্যমে । সাধারণভাবে বৈশ্যরাই ব্যবসাবাণিজ্যের কাজে নিযুক্ত থাকত । পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ‘শ্রেষ্ঠী’ কথাটি পাওয়া যায় । শ্রেষ্ঠী কথাটীর অর্থ হল ধনী বণিক । যজুর্বেদের একটি তথ্য থেকে মনে হয় যে, ব্যবসাবাণিজ্য ক্রমশ বংশানুক্রমিক পেশায় পরিণত হচ্ছিল । ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসারের এটি একটি বড় প্রমাণ । ঋক্বৈদিক যুগের তুলনায় সামুদ্রিক বাণিজ্য অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছিল । তবে এযুগেও সাগরপাড়ি দেওয়ার উল্লেখ বেদে বিশেষ পাওয়া যায় না । যাতায়াতের পথও খুব সুগম ছিল না । এই যুগে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসারের আর একটি প্রমাণ হল ‘কুসীদ’ও ‘কুসীদিন’ শব্দদুটির প্রয়োগ । কুসীদ বলতে বোঝায় ঋণ ও কুসীদিন হল যে ব্রাহ্মণ ঋণ দেয়, অর্থাৎ, সুদের কারবারি । তবে এই সময়েও ব্যবসাবাণিজ্যের প্রয়োজন বিনিময় প্রথার বদলে ধাতব মুদ্রা প্রচলিত ছিল কিনা, তা বলা কঠিন । তবে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ট শতকের পর ধাতব মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়েছিল ।
►নগরের উত্থান::
হরপ্পা সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রিক । কিন্তু আর্যরা গ্রামে বসবাস করত। ঋক্বেদে নগরের উল্লেখ খুবই কম । ঋক্বেদে নগরকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বর্ণনা করা হয়েছে । বলা হত, যাদের গায়ের রং কালো, নাক ভোঁতা এবং অবোধ্য ভাষায় কথা বলে, তারাই নগরে বাস করে । এখানে নগর ধ্বংস করার মধ্যে বীরত্ব ও গৌরব প্রকাশ করা হয়েছে এবং নগর ধ্বংসের বর্ণনাও আছে । ঋক্বেদে ইন্দ্রকে ‘পুরন্দর’, অর্থাৎ, পুর বা নগরের ধ্বংসকর্তা হিসাবে সম্মানিত করা হয়েছে ।
পরবর্তী বৈদিক যুগে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারের ফলে মধ্য গাঙ্গেও উপত্যকায় নগরের পুনরাবির্ভাব ঘটে । ঋক্বৈদিক যুগে আর্যদের নগর সম্পর্কে যে ঘৃণার ভাব ছিল, পরবর্তী বৈদিক যুগে তা অনেকটাই কমে গিয়েছিল । তা সত্ত্বেও এই সময়েও নগরের উল্লেখ ও নগরজীবনের কথা বৈদিক সাহিত্যে বেশি পাওয়া যায় না । আসলে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ট শতক থেকেই নগরায়ন প্রক্রিয়া ঠিকভাবে শুরু হয় । পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ও পালি সাহিত্য থেকে এই বিষয়ে বিশদ তথ্য পাওয়া যায় । বৌদ্ধশাস্ত্র অনুসারে বুদ্ধের সময় নগরের সংখ্যা ছিল ষাট । এর মধ্যে ছয়টির নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য । সেগুলি হল- বারাণসী, কৌশাম্বী, চম্পা, রাজগৃহ (রাজগির), শ্রাবস্তী ও কুশিনগর । এর মধ্যে কুশিনগর ছাড়া সব কটিই ছিল কোনো না কোনো মহাজন পদের রাজধানী । সাহিত্যিক উপাদান থেকে প্রাপ্ত এইসব শহরের বিবরণ প্রায় একই রকম । অথাৎ,তা থেকে শহরগুলির মধ্যে কোনটি ছোটো বা বড়ো, কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রভৃতি বোঝা মশকিল । তাই আমাদের প্রত্নত্বের ওপর নির্ভর করতে হয় । প্রত্নত্ত্বের সাহায্যে কোনো একটি বিশেষ শহরের বিবর্তন, অর্থাৎ কীভাবে সময়ের সঙ্গে তার আয়তন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল, তা জানা যায় । প্রত্নতত্বের সাহায্যেই আমরা জানতে পেরেছি উত্তর ভারতে প্রাচীনতম নগরপ্রাকার ছিল অত্রঞ্জিখেড়ায় । কৌশাম্বীতে আবিষ্কৃত হয়েছে আর একটি বিশাল প্রকার । মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার বাইরে দুটি গুরুত্বপূর্ণ নগর হল মালবদেশের অন্তর্গত এরান এবং অবন্তী মহাজনপদের রাজধানী উজ্জয়িনী । অধিকাংশ নগর প্রাকার কাদামাটি বা কাদামাটির ইট দিয়ে তৈরি হত । কিন্তু রাজগৃহের প্রাকার তৈরি হয়েছিল পাথর দিয়ে । খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে এই নগরের উদ্ভব ঘটে ছিল । নগরগুলি গড়ে ওঠার মূল কারণ ছিল ব্যাপকভাবে লোহার ব্যবহারের ফলে উদবৃত্ত উৎপাদন । অন্তত ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা এবং ডি.ডি.কোশাম্বি তাই মনে করেন । এরা অবশ্য নগরগুলির উত্থানের জন্য ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার, কারিগরি শিল্পের বিকাশ ও রাজতন্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধির ভূমিকাও স্বীকার করেছেন । তবে তাঁদের মত সবাই (যেমন, অমলানন্দ ঘোষ) মেনে নেয়নি । নগরগুলি গড়ে ওঠার আর একটি কারণ হল আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ । এর ফলে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটে, যা নগরের উত্থানের সহায়ক হয়েছিল ।
শ্রেণি ও জাতিগত বিন্যাস::
আর্যসমাজ প্রথমে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল- যোদ্ধা বা অভিজাত, পুরহিত ও সাধারণ মানুষ । জাতিগত কোনো বিভেদ তখন ছিল না । পেশা বংশানুক্রমিক ছিল না । বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে বিবাহে কোনো বিধি নিষেধ ছিল না । একত্রে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারেও কোনো নিশেধাজ্ঞা ছিল না । সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন সুদৃঢ় করার জন্যই এই শ্রেণি বিভাগ বা শ্রমভাগ করা হয়েছিল । তবে শ্রেণিগত হিসাবে না হলেও জাতিগত দৃষ্টিকোণে দাসদের থেকে আর্যদের পৃথকীকরণের একটা প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছিল । আর্য স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য । গায়ের রং ছিল এর মাপকাঠি । দাসদের গায়ের রং ছিল কালো, আর আর্যদের ফর্সা । সংস্কৃত ভাষায় বর্ণ বলতে গায়ের রংকেই বোঝায় । এভাবে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে একটা ভেদরেখা গড়ে তোলা হয়েছিল । আর্যদের বলা হত দ্বিজ । যারা উপবীত ধারণের অধিকারী তাদের দ্বিজ বলা হত । যোদ্ধা বা অভিজাত (ক্ষত্রিয়), ব্রাহ্মণ (পুরহিত) ও বৈশ্য (বণিক) ছিল দ্বিজ । দাসদের বলা হত শুদ্র । কিন্তু আর্য ও অনার্যদের মধ্যে এই ভেদ সম্পূর্ণরূপে বজায় রাখা সম্ভব ছিল না । ঋক্বেদে অবশ্য আর্য-অনার্যের মিশ্রণের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না । কিন্তু যজুর্বেদে আর্য-অনার্যদের যে সংমিশ্রণ প্রক্রিয়া শুরু হয়, ক্রমশ তার বিবর্তন ঘটতে থাকে । তা ছাড়া কৃষির উন্নতি এবং শিল্প ও ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসারের জন্য আর্যদের যে সব পরিবর্তন ঘটে, তার ফলে জাতিও শ্রেণিগত কাঠামোও পরিবর্তিত হতে থাকে । আর্য বৈশ্যরা ক্রমশ ব্যবসায়ী ও ভূস্বামীতে পরিণত হতে থাকে । শুদ্ররা চাষবাসের কাজে হাত দেয়, তারা ক্রমশ আর্যসমাজে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে । তবে তাদের দ্বিজ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি । ফলে তারা বৈদিক ধর্মের ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহনের সুযোগ পায়নি বলে নিজেদের দেব-দেবীর উপাসনা করত । অন্যদিকে জাতিভেদ প্রথা বংশানুক্রমিক হয়ে পড়ে । এইভাবে জাতিভেদ প্রথা কঠোর হতে থাকে । তবে শুদ্রদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ ছিল ।
বর্ণ ও জাতিভেদের পাশাপাশি কারিগরি শিল্পের বিকাশ ও ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসারের ফলে পেশাগত কয়েকটি শ্রেণির উদ্ভব হয় । যজুর্বেদে এর বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় । এই বিবরণে আছে –কামার, কুমোর, মণিকার, তির-ধনুক নির্মাতা, ধীবর, গো-পালক, সুরাকার, হস্তী ও অশ্বপালক, ব্যাধ, শিকারি ইত্যাদি । অথর্ব বেদ থেকে জানা যায় ওই সময় চিকিৎসকের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বাড়ছিল । খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ট শতকে জিবক ছিলেন বিখ্যাত চিকিৎসক । পালি সাহিত্য থেকে আমরা রজকের কথা জানতে পারি । বণিক ও শ্রেষ্ঠীর কথা আগেই বলা হয়েছে।
আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের ফলে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম ও ষষ্ঠ শতকে যে শ্রেণিবিভাজন দেখা দিল, তার ফলে সমাজ মুষ্টিমেয় ধনী ও অসংখ্য দরিদ্র- এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল । ব্যাপক ধনবৈষম্য দেখা দিল । ব্রাহ্মন ও ক্ষত্রিয় রইল সমাজের মাথায় । এই দুই শ্রেণিই কায়িক পরিশ্রম থেকে অব্যহতি পেল । কিন্তু সমাজের নীচু তলার মানুষ- চাষাভুষোর দল, মজুর, কারিগর হল অত্যাচার আর অবিচারের শিকার।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন